বিষয়ঃ বাংলা ১ম পত্র
উপন্যাস – ১৯৭১
চরিত্র পরিচিতি
মেজর এজাজ: '১৯৭১' উপন্যাসে মেজর এজাজ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
কমান্ডিং অফিসার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার নেতৃত্বে
পাকিস্তানি বাহিনী নীলগঞ্জ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে সেনাক্যাম্প স্থাপন করে।
মেজর এজাজ তার বাঙালি সহকারী রফিকের মাধ্যমে গ্রামের মানুষদের জেরা করেন এবং শাস্তি
দেন। গ্রামের মসজিদের ইমাম ও স্কুলশিক্ষক আজিজের মতো নির্বিরোধী মানুষ তার নিপীড়নের
শিকার হয়েছেন। তার ধারণা, নীলগঞ্জ গ্রামের জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে আছে এবং গ্রামবাসী
তাদের সাহায্য করছে। পূর্ববর্তী খুনের অভিযোগে কৈবর্ত মনা ও তার ছোট ভাইকে হত্যা করে
নিষ্ঠুরতার নমুনা সৃষ্টি করেছেন মেজর। বিকৃত মস্তিষ্ক এ ব্যক্তিটি নৃশংসতাকে বৈধতা
দেওয়ার জন্য দার্শনিকতার বুলি আওড়ান। মেজর এজাজ চরিত্রটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর
নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও কুটিলতার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে
পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে লেখক উপস্থাপন করেছেন এ চরিত্রের মাধ্যমে। মেজর এজাজ চরিত্রটিকে
আর দশজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। মিলিটারির দলনেতা হিসেবে নীলগঞ্জ
গ্রামে তার আসার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক তার বন্ধুকে অপহরণ করার
বিষয়টি। একপর্যায়ে তিনি পাকবাহিনীর নির্মম আগ্রাসনকে 'সারভাইভালের প্রশ্ন' বলে বৈধতা
দিতে চেয়েছেন। মেজর এজাজ নীলগঞ্জের মানুষজন, তার সহচর রফিক তথা বাঙালিদের মনস্তত্ত্বকে
বিশ্লেষণ করেছেন নিখুঁতভাবে। এ চরিত্রের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম
পাকিস্তানিদের নেতিবাচক মানসিকতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। মেজর এজাজ বাঙালিদের মৃত্যুভয়
দুর্বলতা নিয়ে চরম কটাক্ষ করেছেন এবং বাঙালির আত্মসম্মানবোধ কুকুরের চেয়েও নিম্নতর
বলে অভিহিত করেছেন। মাত্র পঁচিশ ভাগ বাঙালিকে মুসলিম ও বাকি পঁচাত্তর ভাগ বাঙালিকে
হিন্দু বলে অভিহিত করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে মুখর, নৃশংস, অত্যাচারী, কুটিল
চরিত্র মেজর এজাজ পাকিস্তানি আত্মগর্ব মানসিকতা ও আগ্রাসনের প্রতীক।
রফিক: '১৯৭১' উপন্যাসে রফিক চরিত্রটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মেজর
এজাজ আহমেদের বাঙালি সহকারী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি মিলিটারির কমান্ডিং অফিসার
মেজর এজাজ তার সেনাদল নিয়ে নীলগঞ্জ গ্রামে প্রবেশ করে প্রাইমারি স্কুলে সেনাক্যাম্প
স্থাপন করে গ্রামের মানুষের প্রতি নৃশংস নিপীড়ন শুরু করেন। রফিক মেজর এজাজের সহকারী
হলেও বাঙালিদের প্রতি তার সহানুভূতি ছিল। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন- ইমাম, আজিজ মাস্টার,
জয়নালসহ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেজরের দোভাষীর ভূমিকা পালন করেছে।
উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহে রফিকের ব্যক্তিজীবনের তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। সে একজন শিক্ষিত
যুবক কিন্তু তার পরিবার, বাড়ি কিংবা পেশার বিষয়টিও রহস্যমণ্ডিত করে উপস্থাপন করেছেন
ঔপন্যাসিক। আপাতদৃষ্টিতে নিতান্ত সাধারণ চরিত্র হলেও বাঙালিদের প্রতি তার সহানুভূতি
এবং নীলগঞ্জ গ্রামটিকে পাকবাহিনীর আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার প্রচ্ছন্ন ভূমিকার বিষয়টি
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নীলগঞ্জ গ্রামের মানুষদের সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সে গোপন
করেছে মেজর এজাজ আহমেদের কাছে। বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের নেতিবাচক মনোভাব, জাতিগত
বিদ্বেষ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্তিত্বের সংকটের প্রশ্নে মেজর এজাজ আহমেদের সঙ্গে দ্বৈরথে
অবতীর্ণ হয়েছে রফিক। উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্সের দিকে তার চরিত্রটি হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়ে রফিক চরিত্রটি অসীম সাহসী হয়ে ওঠে। গ্রামের জঙ্গলে
অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, রসদ সরবরাহের বিষয়টি জানত রফিক। এমনকি কৈবর্তপাড়ায়
তল্লাশি চালাতে নিরুৎসাহিত করেছে মেজরকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য না দিয়ে সে মেজরকে বিভ্রান্ত করতে
চেয়েছে। ঝড়ের সময় একটা পাগলের বনের ভেতরে ছুটে যাওয়া দেখে রফিকের উল্লসিত হয়ে ওঠা তার
চরিত্রকে রহস্যময় করে তুলেছে। রফিকের প্রতি মেজরের সন্দেহজনক মনোভাব থাকলেও তার প্রতি
নির্ভরশীলতাও ছিল। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে রফিক নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। রফিক প্রবল
আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী সত্তায় পরিণত হয়েছে। একজন বাঙালি হয়ে সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর
মেজরকে এ দেশ থেকে জীবিত ফিরে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
রফিক চরিত্রটিকে সাধারণ টাইপ চরিত্র থেকে সংবেদনশীল, দেশপ্রেমিক ও বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষাবলম্বনকারী সভায় বিবর্তিত করেছেন ঔপন্যাসিক।
ইমাম সাহেব: '১৯৭১' উপন্যাসের স্থানিক পটভূমি নীলগঞ্জ গ্রামের
বিদেশি তথা অস্থানীয় ব্যক্তি ইমাম সাহেব। এই দুর্গম অঞ্চলের মসজিদে এসে তার ইমামতি
করার বিষয়টি রহস্যমন্ডিত। তিনি মসজিদে থাকেন এবং মাসের পনেরো দিন অবস্থাসম্পন্ন জয়নাল
মিয়ার বাড়িতে খান। বাকি পনেরো দিন তিনি পালা করে অন্য ঘরগুলোতে খান। কিছুদিন হলো তিনি
বিয়ে করে এ গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও গ্রামের মানুষজন তাতে
সায় দেয় না। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে মিলিটারিরা ক্যাম্প স্থাপন করলে তিনি কৌতূহলবশত
সেদিকে এগিয়ে যান এবং মিলিটারির হাতে আটক হন। পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাকে শারীরিকভাবে
প্রহার করে রক্তাক্ত করে ফেলে। ইমাম সাহেব চরিত্রটি ঔপন্যাসিক বিনির্মাণ করেছেন ধর্মভীরু,
পরহেজগার ও দুর্বল মানসিকতার ব্যক্তি হিসেবে। মিলিটারি তাকে এবং আজিজ মাস্টারকে আটক
করার পর থেকে তিনি শুধু দোয়া ইউনুস পড়েছেন এবং মাস্টারকেও পড়তে বলেছেন। বিপদের মুহূর্তেও
তিনি তার পরহেজগারিতা এবং সাচ্চা মুসলমানরূপে নিজেকে প্রমাণ করতে অজুর পানি চেয়েছেন
এমনকি পানির অভাবে অজু না করতে পেরে অনুশোচনা বোধ করেছেন। ইমাম সাহেব চরিত্রে ঔপন্যাসিক
বাঙালি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের প্রতীকী চিত্রায়ণ করেছেন। কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মনা ও তার
ছোট ভাই বিরুকে ইমাম সাহেবের সামনে শাস্তি দেওয়ার সময় বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে বমি
করে ফেলেন তিনি। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়ে জেরা
শুরু করলে তিনি সাহসের সঙ্গে মিলিটারির প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ইমাম সাহেব চরিত্রটি
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার এবং নির্বিরোধী বাঙালি
সত্তার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
আজিজ মাস্টার: '১৯৭১' উপন্যাসে আটত্রিশ বছর বয়সি আজিজ মাস্টার
একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সে নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। আজিজ মাস্টার
নীলগঞ্জের স্থানীয় লোক নয়। রূগণ চেহারার এ লোকটি হাঁপানিসহ নানা রোগে জর্জরিত। গ্রামের
অবস্থাপন্ন ব্যক্তি জয়নাল মিয়ার বাড়িতে আশ্রিত আজিজ মাস্টার স্বভাবকবি। জয়নাল মিয়ার
বড় মেয়ে মালাকে নিয়ে লেখা তার তিনটি কবিতা নেত্রকোনার 'কিষাণ' পত্রিকা থেকে প্রকাশিত
হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি মিলিটারি নীলগঞ্জ গ্রামে আসে এবং
প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। মেজর এজাজ আজিজ মাস্টারকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে
জেরা করেন এবং তাকে আটকে রাখেন। বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদে সে নীলগঞ্জ গ্রামে মুক্তিবাহিনীর
অবস্থান অস্বীকার করে। আজিজ স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে বলে স্বীকারোক্তি দেয় মেজরের
কাছে। জয়নাল মিয়ার মেয়ের প্রতি তার অনুরাগ এবং তাকে নিয়ে কাব্যচর্চার বিষয়টি জানতে
পেরে তাকে বিয়ে দিতে চান মেজর। ইমাম সাহেবের নির্যাতিত চেহারা দেখে কাপড় ভিজিয়ে ফেলে
সে। উপন্যাসিক আজিজ মাস্টার চরিত্রটিকে গ্রামীণ এক ভীতু মানুষ থেকে সাহসী ব্যক্তিতে
পরিণত করেছেন যুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতে। মিলিটারি তাকে বিবস্ত্র করে জয়নাল মিয়ার সামনে
উপস্থিত করলে সে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। তার সামনে মিলিটারি কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মনা
ও তার ছোট ভাই বিরুকে গুলি করে হত্যা করলেও সে নির্বিকার চেয়ে থেকেছে। আজিজ মাস্টার
গ্রামের সাধারণ একজন স্কুলশিক্ষর থেকে সাহসী মানুষে পরিণত হওয়ার দিকটি মুক্তিযুদ্ধের
প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। এ চরিত্রটি মুক্তিযুদ্ধে নিপীড়িত বাঙালি সাধারণ
জনতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
নীলু সেন: নীলু সেন '১৯৭১' উপন্যাসে বর্ণিত নীলগঞ্জ গ্রামের
একমাত্র পাকা দালানের বাসিন্দা। দুবিঘা জমির ওপর এই কোঠাবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন তাঁর
পূর্বপুরুষ সুসং দুর্গাপুরের মহারাজার নায়েব চন্দ্রকান্ত সেন মশাই। গৃহপ্রবেশের দিন
সর্পাঘাতে মৃত্যু হলে তার জমানো সম্পত্তির খোঁজ পায়নি পরিবার। চন্দ্রকান্ত সেনের উত্তরপুরুষ
নীল সেন এ বাড়িতে তার ভাগ্নে বলাইসহ বসবাস করেন। গ্রামের মানুষজন নীল সেনকে যথেষ্ট
শ্রদ্ধা করে এবং সালিশিতে ডাকে। বিয়েশাদিসহ সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যমণি থাকেন সদালাপী
ও মিষ্টভাষী নীলু সেন। গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি আসার পর নীলু সেনের শারীরিক অবস্থার
অবনতি ঘটে। তলপেটে প্রচন্ড ব্যথায় মুখ দিয়ে গাঁজলা বের হয় তার। শেষরাতে সুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে
পড়া নীলু সেনকে ডেকে তুলে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। মুক্তিযুদ্ধের
সময় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্মম আগ্রাসন চালিয়েছিল পাকিস্তানি
সেনারা। নীলু সেন নির্বিরোধী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনাদের নির্মমতা থেকে
রক্ষা পাননি।
জয়নাল মিয়া: '১৯৭১' উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র জয়নাল মিয়া।
সে নীলগঞ্জ গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সম্পদশালী ব্যক্তি। প্রচুর বিষয়সম্পত্তির মালিক
জয়নাল মিয়ার মধুবন বাজারে দুটি ঘরও আছে। জয়নাল লোকটি খুব একটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয়।
সে সবার মন রেখে আলাপচারিতা করার চেষ্টা করে। গ্রামের সালিশিতে সব পক্ষের মতকে সমর্থন
করতে গিয়ে সে মাঝে মাঝে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তবুও গ্রামের সাধারণ মানুষজন তাকে
সহ্য করে। কারণ, সে সম্পদশালী। সমাজের জনহিতকর কাজে জয়নাল মিয়ার অবদান লক্ষণীয়। গ্রামের
মসজিদের ইমাম সাহেব তার বাড়িতে মাসের পনেরো দিন খান। গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
প্রধান শিক্ষক আজিজ মাস্টার তার বাড়িতে আশ্রিত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নীলগঞ্জ প্রাইমারি
স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করলে সে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' স্লোগানে মিছিল করে পাকবাহিনীর
ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। মিলিটারিদের প্রতি জয়নাল মিয়ার প্রচ্ছন্ন ভীতি থাকলেও সে
বাইরে প্রকাশ করে না। গ্রামের মানুষের সঙ্গে সে মিলিটারি আসার পর করণীয় সম্পর্কে আলোচনা
করে এবং নীলু সেনের সঙ্গে পরামর্শ করতে চায়।' জয়নাল মিয়া গ্রামের জঙ্গলা মাঠে প্রায়
একশ মুক্তিযোদ্ধার লুকিয়ে থাকার খবর জানলেও গোপন রেখেছিল। গ্রামের ইমাম সাহেব ও আজিজ
মাস্টারকেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি সে জানায়নি। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে
জয়নাল মিয়া দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিসংগ্রামে অবদান রেখেছে। গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি
জয়নাল দেশের ক্রান্তিলগ্নে প্রবল ব্যক্তিত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে।
বদিউজ্জামান: বদিউজ্জামান '১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসের অন্যতম
চরিত্র। মধুবন বাজারে তার একটা মনিহারি দোকান আছে। বদিউজ্জামানের সাংসারিক অবস্থা মোটামুটি
ভালো। গ্রামের যে জনাকতক মানুষের টিনের ঘর আছে তাদের মধ্যে একজন সে। বদিউজ্জামান বাড়ি
থেকে মধুবন বাজারে যাওয়ার সময় মিলিটারি দেখে মত বদল করে। জালা মাঠের কাছাকাছি আসতে
সে দ্বিতীয় মিলিটারির দল দেখে জঙ্গলা মাঠের দিকে ছুটে যায় এবং কোমর পানিতে নেমে ঘণ্টাখানেক
বসে থাকে। সে দীর্ঘক্ষণ বিলের পড়া পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে। মিলিটারির ভয়ে এবং প্রবল তৃষ্ণায়
সে বিলের পানি খায়। ভীতি ও বিহ্বলতায় বদিউজ্জামানের মনে মিলিটারি সম্পর্কে মনস্তাত্তিক
ভাবনার প্রকাশ ঘটে। গ্রামে নতুন প্রবেশ করেই প্রথম ধাক্কায় চল্লিশ-পঞ্চাশজন মানুষকে
মেরে ফেলার বিষয়টি সে বিশ্বাস করতে পারে না। মিলিটারিদের পোশাকের কারণে তাদের রক্ত
গরম বলে তার অভিমত। গ্রামে হঠাৎ ঝড় শুরু হলে শুধু তার টিনের বাড়িটির ছাদ উড়ে যায়। গ্রামে
পাকিস্তানি মিলিটারির আগমনে বিহ্বল ও হতচকিত হয়ে পড়া গ্রামের মানুষের প্রতিনিধি বদিউজ্জামান।
চিত্রা বুড়ি: নীলগঞ্জ গ্রামের প্রান্তিক কৈবর্ত সমাজের অসহায়
বৃদ্ধা চিত্রা বুড়ি। গত বছর কৈবর্তপাড়ায় মনা কৈবর্ত খুন করেছিল চিত্রা বুড়ির ছেলেকে।
কিন্তু গ্রামের মাতব্বরদের অনাগ্রহের কারণে তার বিচার হয়নি। এমনকি কৈবর্তরা বুড়িকে
খানায় নালিশ করলে জীবননাশের হুমকি দেয়। এরপর বুড়ি নীলু সেনের পাকা দালানে বসবাস করতে
শুরু করে। হতদরিদ্র চিত্রা বড়ি নীলগঞ্জের প্রথম ভিক্ষুক। নীলু সেনের দালানে থাকতে ভালো
না লাগায় বুড়ি কালীমন্দিরে থাকতে শুরু করে। দেবী কালীর কাছে সে সন্তান হত্যার বিচারের
জন্য ফরিয়াদ জানায়। অবচেতনে বুড়ি ভাবে, দেবী কালী তার আহ্বানে সাড়া দেন। এমনকি সন্তান
হত্যার বিচার চেয়ে দেবীর কাছে জোড়া পাঁঠা মানত করে সে। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের
মতে, চিত্রা বুড়ি দুষ্ট প্রকৃতির মহিলা। কারণ সে মসজিদের একটি বদনা চুরি করেছে।
মালা: মালা চরিত্রটি উপন্যাসে বর্ণিত নীলগঞ্জ গ্রামের সম্পদশালী
ব্যক্তি জয়নাল মিয়ার বড় মেয়ে। তার বয়স আনুমানিক তেরো-চৌদ্দ। জয়নাল মিয়ার বাড়িতে আশ্রিত
আজিজ মাস্টারকে সে মামা বলে ডাকে। কিন্তু আজিজ মাস্টার তার প্রতি প্রণয়াসক্ত এবং তাকে
নিয়ে কবিতা রচনা করে।
নিজাম পাগল: নীলগঞ্জ গ্রামের অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষ নিজাম।
নিজাম পাগল গ্রামের মতি মিয়ার শ্যালক। বেশিরভাগ সময় সে সুস্থ থাকলেও মাঝে মাঝে তার
মাথা গরম হয়ে যায়। তখন সে গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা ছোটাছুটি করতে থাকে। দুপুরে রোদ
বেড়ে গেলে জঙ্গলার বনে ঢুকে পড়ে। বনে ঘোরাফেরা করলেও তাকে সাপে কাটে না। সে গ্রামের
মানুষদের কোনো উপদ্রব করে না। মেজর এজাজের মতে সে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের খবর বহনের
দূত হিসেবে কাজ করে।
মীর আলি: মীর আলি এ উপন্যাসের অন্ধ এক বৃদ্ধ। সে বদিউজ্জামানের
বাবা। বয়সের কারণে সে একা নিজের কাজকর্ম করতে পারে না। একমাত্র নাতনি পরীবানুকে সঙ্গ
দেওয়া তার কাজ। বৃদ্ধ হলেও তার অনুভূতিশক্তি বেশ প্রবল। মেজর এজাজ ও রফিকের পদচারণা
সে বুঝতে পারে। ক্ষুধা-পিপাসার তাড়নায় সে ছেলে ও পুত্রবধূকে বিরক্ত করে। বৃদ্ধ ও অসুস্থ
হলেও তার ধর্ম পালনে নিষ্ঠা লক্ষণীয়।
অনুকা: অনুফা বদিউজ্জামানের স্ত্রী এবং এক সন্তানের জননী। গৃহলক্ষ্মী
অনুফা শ্বশুরের সেবা করে এবং সংসার সামলে রাখে।। আবার স্বামী ঘরে না থাকলে সে শ্বশুরের
সেবা-যত্ন ঠিকমতো করে না। মিলিটারি আসার পর হঠাৎ ঝড়ে তাদের ঘরের চাল উড়ে গেলে সে স্বামীর
প্রতীক্ষায় বসে থাকে। সংকটময় মুহূর্তে সে সংসারের কাজে মন দিতে পারে না।
বলাই: নীলগঞ্জ গ্রামের নীলু সেনের ভাগ্নে বলাই। মামার সাথে সে
বিশাল বাড়িতে বাস করে। মামার স্নেহধন্য বলাই হঠাৎ মামা অসুস্থ হলে তাঁর সেবা করে। পাকিস্তানি
মিলিটারি নীলু সেনকে গুলি করে হত্যা করার সময় সে কালী প্রতিমার আড়ালে লুকিয়ে প্রাণরক্ষা
করে।
উপন্যাস থেকে খ তে যেস্কল
দিক থেকে প্রশ্ন হতে পারে।
১. উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি তুলে ধরা।
২. গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন উপাদান ও দিক।
৩. পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও অত্যাচারের আসল চিত্র উপস্থাপন।
অথবা,
৪. মিলিটারির কর্মকাণ্ড ও অবরুদ্ধ গ্রামীণ জনজীবনের উপর প্রভাব।
৫. পাকিস্তানির জাতিগত বিদ্বেষের চিত্র।
৬. দেশপ্রেমের প্রকৃত রূপ।
৭. মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের এবং কৈবর্ত সম্প্রদায়ের ত্যাগ।
৮. মিলিটারির নির্যাতনের প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া
কিছু নমুনা প্রশ্নের
উত্তর
ক) সফদরউল্লাহর মানসিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ ব্যাখ্যা করো।
খ) '১৯৭১' উপন্যাসে প্রতিফলিত নীলগঞ্জের জনজীবনের পরিচয় দাও।
ক) নম্বর প্রশ্নের উত্তর
পাকিস্তানি মিলিটারিদের পশুসুলভ আচরণ সফদরউল্লাহর মানসিক পরিবর্তনের প্রধান
কারণ
'১৯৭১' উপন্যাসে নীলগঞ্জ নামক এক গণ্ডগ্রামে মিলিটারি প্রবেশের পর নানা রকম
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে। ইতঃপূর্বে এই গ্রামের মানুষজন মিলিটারি সম্পর্কে যা জানত,
সর্বই অন্য মানুষের কাছ থেকে শোনা গল্পের মতো। পাকিস্তানি মিলিটারিরা মুসলমান হওয়ায়
তাদের সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক কথা গ্রামবাসী বিশ্বাস করত, যেমন: তারা মুসলমানদের কোনো
ক্ষতি করে না, কালিমা জিজ্ঞেস করে, মুসলমান মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার তো সম্ভাবনাই নেই
ইত্যাদি। জয়নাল মিয়ার সাথে কথা বলে তাই সফদরউল্লাহ আশ্বস্ত হয় যে গ্রামে মিলিটারি এলেও
তার পরিবারের নারী সদস্যদের অন্য কোথাও স্থানান্তর করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার বিশ্বাস
ভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। মিলিটারি সুবাদারের হাতে তার স্ত্রী ও শ্যালিকা নির্যাতনের শিকার
হলে তা তার মনে ব্যাপক আঘাত হানে।
ফলে সে মিলিটারিদের প্রতি চরম ঘৃণা বোধ করে এবং দা হাতে নিয়ে নির্যাতনকারী
মিলিটারিকে হত্যা করতে বেরিয়ে যায়।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হিসেবে
যিনি নিজের অবস্থানকে সুউচ্চে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ।
এই গুণী কথাসাহিত্যিক ছিলেন কালির সামান্য আঁচড়েই মানুষ ও জনজীবনের আলেখ্য তুলে ধরতে
সিদ্ধহস্ত। '১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসও এর ব্যতিক্রম নয়। এ উপন্যাসে তিনি সুনিপূর্ণ হাতে
নীলগঞ্জ গ্রামের জনজীবনের পরিচয় তুলে ধরেছেন।
লেখকের বর্ণনা মতে, জঙ্গলা মাঠের পিছনে নীলগঞ্জ গ্রাম। দরিদ্র, শ্রীহীন ত্রিশ-চল্লিশ
ঘরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। বিস্তীর্ণ জলাভূমি গ্রামটিকে কান্তের মতো দুইদিকে ঘিরে আছে।
এখানকার লোকজন প্রধানত কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। এখানকার জমি যথেষ্ট পরিমাণে
উর্বর নয় কিংবা এরা ভালো চাষি নয়। তবে শীতকালে এরা প্রচুর রবিশস্য ফলায়। বর্ষার আগে
চাষ করে তরমুজ ও বাঙ্গি। গ্রামের অধিকাংশ ঘরেই খড়ের ছাউনি। সম্প্রতি কয়েকটি টিনের ঘর
হয়েছে। অতীতে চন্দ্রকান্ত সেন প্রচুর ধনসম্পদ করলেও তার বর্তমান উত্তরসূরি নীলু সেনের
অবস্থা যেন ব্যাঙের আধুলির অধিকারী। বর্তমানে গ্রামে সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী ব্যক্তি
হলো জয়নাল মিয়া। টাকাপয়সা বেশ থাকলেও লোকটি মেরুদণ্ডহীন।
গ্রামে বিদেশি বা বাইরের লোক আছে দুইজন। একজন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব এবং
দ্বিতীয়জন হলেন নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আজিজ মাস্টার। ইমাম সাহেব মসজিদেই
থাকেন এবং আজিজ মাস্টার থাকেন জয়নাল মিয়ার বাড়িতে। দুইজনের খাবারদাবারের ব্যবস্থা হয়
প্রধানত জয়নাল মিয়ার বাড়ি থেকে। ইমাম সাহেবের খাবার অবশ্য গ্রামের আরও কয়েক বাড়ি থেকেও
আসে।
নীলগঞ্জের যে দিকটায় জলাভূমি, একদল কৈবর্ত থাকে সেদিকে। মাছ ধরার সিজনে জলমহালে
মাছ ধরতে যায়। নীলগঞ্জের কেউ এদের ঘাঁটায় না।
এমনকি এরা খুনখারাবি করলেও নীলগঞ্জের মাতব্বররা কিছুই না জানার ভান করে। কৈবর্তপাড়ার
চিত্রা বুড়ি সন্তান হারিয়ে বিচারের আশায় এখানে-সেখানে ঘুরলেও কোনো প্রতিকার পায় না।
গ্রামের একমাত্র ভিক্ষুক সে। এদের বাইরে একজন পাগলও আছে এ গ্রামে-মতি মিয়ার শ্যালক
নিজাম। ছোটাছুটি করা এবং বনের ভিতরে বসে থাকা ছাড়া সে কোনো উপদ্রব করে না।
সরশেষে বলা যায় যে, নীলগঞ্জের জনজীবন বাংলার আর দশটা সাধারণ গ্রামের জনজীবনের
মতোই। সহজ, স্বাভাবিক ও কৃত্রিমতাবর্জিত জীবনযাপনে অভ্যন্ত এ গ্রামের লোকজন।
ক)মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে অনেকেই এরকম করবে।'- এ উক্তিটি কার?
উক্তিটি করার কারণ কী ছিল? বুঝিয়ে লেখো।
খ)রফিক ও মেজরের সম্পর্কের টানাপড়েন কীভাবে কাহিনির গতিপথকে প্রভাবিত
করেছে? তাদের মধ্যকার সংঘাতের কারণ ব্যাখ্যা করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
'মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে অনেকেই এরকম করবে'- মেজর সাহেবের কথার উত্তরে রফিক
উক্তিটি করেছিলেন।
মেজর এজাজ নীলগঞ্জ গ্রামে এসে একটা আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়। স্থানীয়
প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করার পরপরই স্কুল মাস্টার আজিজ মাস্টারকে স্কুলঘরে বন্দি
করে রাখে। কথা আদায়ের নামে সে পাশবিক অত্যাচার করে। মেজর এজাজ তার সহযোগী বাঙালি যুবক
রফিককে নির্দেশ দেয়, সে যেন আজিজ মাস্টারের পুরুষাঙ্গে ইটের টুকরা ঝুলিয়ে উলঙ্গ অবস্থায়
পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে আনে। আজিজ মাস্টারকে লজ্জাজনক শাস্তি অথবা মৃত্যু- দুইটির মাঝে একটি
বেছে নিতে বললে তিনি লজ্জাজনক শাস্তি বেছে নেন। বাঙালি মাস্টার মৃত্যু এড়িয়ে যেতে চাওয়ায়
সমগ্র বাঙালি জাতিকেই সে কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে।
এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ যেকোনো রকম আচরণই যে করতে পারে এবং তা যে অস্বাভাবিক
নয়- এ কথা বোঝাতেই রফিক প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেন।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে '১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাস রচনা করে তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতির ধারাবাহিকতার
স্বাক্ষর রেখেছেন। এ উপন্যাসে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর কমান্ডার মেজর এজাজ ও তার
সহযোগী হিসেবে কাজ করা এদেশীয় যুবক রফিকের কথোপকথন এবং কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার
সম্পর্কের জটিল ধাঁধা উন্মোচিত হয়েছে।
রফিক মেজর এজাজের সহযোগী হিসেবে মিলিটারি দলের সাথে নীলগঞ্জ গ্রামে প্রবেশ
করে। তিনি অনেকটা দোভাষীর কাজ করেন। প্রথম দেখায় তাকে মেজর এজাজের খাসলোক বলে মনে হলেও
উপন্যাসের কাহিনি যতই এগিয়েছে তাদের উভয়ের সরল সম্পর্কে জটিলতা ততই প্রতিভাত হয়েছে।
নিজ দেশের মানুষের প্রতি অকারণে ঘৃণ্য আচরণ ও হত্যাকাণ্ডে মেজর এজাজের পাশে ছায়ার মতো
সর্বদা অবস্থান করলেও মন থেকে সেসব মেনে নিতে পারেননি রফিক।
ন্যায়বিচার করার নামে মনা ও তার ভাইকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মেজর মূলত গ্রামের
মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলতে চেয়েছে। মনাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি মানলেও
তার নির্দোষ ছোটো ভাইকে শাস্তি দেওয়া মানতে পারেননি রফিক। অবশ্য মেজর এজাজ যুদ্ধকালীন
বাস্তবতার দোহাই দিয়ে 'এই সময়ে কিছু অন্যায় হবেই' বলে নিজের নিষ্ঠুরতাকে বৈধতা দিতে
চায়। এরপর নীলু সেনকে নিজ বাড়িতে হত্যা, সফদরউল্লাহর স্ত্রী ও শ্যালিকার উপর মিলিটারির
নির্যাতন, মসজিদের ইমাম সাহেব ও আজিজ মাস্টারকে স্কুলঘরে বন্দি করে নির্যাতন, বারবার
অদৃশ্য মুক্তিবাহিনীর প্রসঙ্গ টেনে এনে সমগ্র গ্রামবাসীকে শত্রুজ্ঞান করা এবং পুরো
বাঙালি জাতিকে চরম অবজ্ঞা করে কথা বলায় রফিক মানসিকভাবে মেজর এজাজের থেকে আলাদা হয়ে
গিয়েছিলেন। অবশ্য তার এরূপ মনোভাব মেজর এজাজ ঠিকই বুঝতে পারে এবং রফিককে মৃত্যুর মুখোমুখি
দাঁড় করিয়ে দেয়। রফিকের জীবনাবসান ঘটে একজন অদৃশ্য মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। রফিকের মৃত্যুই
মূলত উপন্যাসে শেষ পেরেক ঠোকে, অর্থাৎ বাঙালি আর পাকিস্তানি যে আদতে কেউ কারো নয়, তার
ফয়সালা হয়ে যায়।
উপরের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি গায়ে গা ঘেঁষে চলা মেজর এজাজ ও রফিক যে
আদতে পরস্পর বিরোধী রক্তের মানুষ তা উপন্যাসের শেষে পরিষ্কার হয়েছে। মেজর এজাজ ও রফিকের
সম্পর্কের টানাপোড়েনই '১৯৭১' উপন্যাসের গতিপথ নির্ধারণ করেছে।
ক) আজিজ মাস্টারের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? ব্যাখ্যা করো।
খ) রফিক চরিত্রটি তোমার কাছে কি দ্বিমুখী চরিত্র মনে হয়? তোমার
উত্তরের পক্ষে কারণ দেখাও।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
পাকিস্তানি মিলিটারিদের গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করার মাধ্যমে আজিজ মাস্টারের উপর
করা নির্যাতন পরিণতি পেয়েছে। নীলগঞ্জ গ্রামে মিলিটারি প্রবেশের কিছুক্ষণ পরই মেজর এজাজ
আজিজ মাস্টারকে ডেকে পাঠায়। আজিজ মাস্টার তার সাথে দেখা করতে এলে নানা রকম কথাবার্তার
এক পর্যায়ে মেজর এজাজ তাকে স্কুলঘরে বন্দি করে রাখে। তার সাথে মসজিদের ইমাম সাহেবকেও
বন্দি করা হয়। এরপর শুরু হয় মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তথ্য আদায় করার নামে নির্মম নির্যাতন।
জয়নাল মিয়ার মেয়ে মালার প্রতি আজিজ মাস্টারের দুর্বলতার কথা জানতে পেরে তাকে উলঙ্গ
করে পুরুষাঙ্গে ইটের টুকরা বেঁধে মালার সামনে হাজির করতে চায় মেজর সাহেব। মাস্টার প্রথম
দিকে মৃত্যুভয়ে এহেন চরম অপমানজনক শাস্তি মেনে নিলেও এক পর্যায়ে মৃত্যুকেই নিজের পরিণতি
হিসেবে মেনে নেন। এরপর মেজর সাহেবের নির্দেশে মিলিটারিদের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
রফিক চরিত্রটি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত '১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসের
অন্যতম প্রধান চরিত্র। উপন্যাসের গতিপথ নির্ধারণে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আপাতদৃষ্টিতে
রফিক চরিত্রকে দ্বিমুখী মনে হলেও উপন্যাসের শেষে এসে তিনি নিজেকে স্বদেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ
একজন বীর সৈনিক হিসেবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছেন।
নীলগঞ্জ গ্রামে রফিকের প্রবেশ অত্যন্ত নাটকীয়; মিলিটারি বাহিনীর সাথে, কমান্ডার
মেজর এজাজের সহচর হিসেবে। মেজর এজাজ যেহেতু যথেষ্ট পরিমাণে বাংলায় কথা বলতে পারে না;
তাই তার দোভাষীর ভূমিকায় দেখা যায় রফিককে। নীলগঞ্জের লোকজনের সাথে মেজর এজাজের যেসব
কথাবার্তা হয় সকলই রফিকের মাধ্যমে। ফলে শুরু থেকে উপন্যাসের কাহিনি পরিণতির দিকে ধাবিত
হওয়ার আগ পর্যন্ত যে রফিককে দেখা যায়, তাতে পাকিস্তানি মিলিটারির দোসর মনে করার যথেষ্ট
কারণ রয়েছে। তবে আজিজ মাস্টার ও ইমাম সাহেবকে কথা বলার ক্ষেত্রে বারবার সতর্ক করে দেওয়া
তার চারিত্রিক দ্বৈততার প্রকাশ বলেই মনে হয়।
কাহিনি এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রফিকও ধীরে ধীরে তাঁর চরিত্রের রহস্যময় দিকগুলো
প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে মেজর এজাজের বর্বর আচরণই অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তিনি মেজর
এজাজের সাথে চলতে চলতেই দেখেছেন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা এ দেশের মানুষকে তাদের মতো
মানুষ বলে গণ্য করে না। 'তোমার দেশ' বলে রফিকের সাথে কথা বললে রফিক এটিকে বিশেষভাবে
দৃষ্টিগ্রাহ্য করতে উদ্যত হলে মেজর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। উভয়ই যেন
উভয়কে নতুন করে চেনার পথে যাত্রা শুরু করে এখান থেকে। রফিক লক্ষ করেন, মেজর এজাজ কারণে-অকারণে
চরম নিষ্ঠুরতা দেখায় মূলত গ্রামের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলতে। মিলিটারিদের অত্যাচার,
নির্যাতন, নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া, দোষী-নির্দোষ নির্বিচারে যাকে-তাকে হত্যা করার
এসব দৃশ্য যে সারা দেশেই পাকিস্তানিরা করে যাচ্ছে, তা আর বুঝতে বাকি থাকে না 'তাঁর।
তিনিও ধীরে ধীরে খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে উদ্যত হন। একপর্যায়ে মেজর এজাজও বুঝে যায় যে,
তার জন্য রফিকের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মিলিটারিদের দিয়ে গুলি
করিয়ে তাঁকে হত্যা করে।
পুরো উপন্যাস জুড়ে রফিকের কার্যকলাপ বেশির ভাগ সময়ই পাঠককে দ্বিধাগ্রস্ত করে।
তবে বাঙালি ও বাংলাদেশের উপর ক্রমাগত নিষ্ঠুরতা চালানো পাকিস্তানি মিলিটারি তাঁর চোখ
খুলে দিয়েছে। হাসতে হাসতে দেশমাতৃকার বীরসন্তান হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নিয়ে তিনি নিজেকে
অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন.
ক) মীর আলিকে মেজর এজাজ কেন সালাম দিলেন? ব্যাখ্যা করো।
খ) নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে যুদ্ধের বর্বরতা '১৯৭১' উপন্যাসে কীভাবে
রূপায়িত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করো।
ক) নম্বর প্রশ্নের উত্তর
মীর আলিকে দেখে নিজের অন্ধ বাবার কথা মনে পড়ায় তাকে মেজর এজাজ সালাম দেয়।
'১৯৭১' উপন্যাসে নীলগঞ্জ গ্রামে যে পাকিস্তানি মিলিটারিদের দল এসে ক্যাম্প
করেছে তাদের কমান্ডার হলো মেজর এজাজ। সে একদিন তার সহচর বাঙালি যুবক রফিককে নিয়ে গ্রামে
ঘুরতে বের হয়। সে সরেজমিনে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে চায়। পথিমধ্যে বৃদ্ধ মীর আলিকে সে
দেখতে পায় বাড়ির বাইরে টুলের উপর বসে থাকতে। রফিকের মাধ্যমে সে জানতে পারে যে লোকটি
অন্ধ। বাড়ির বাইরে বসা অন্ধ বৃদ্ধ লোকটিকে বসে থাকতে দেখে তার নিজের বাবার কথা মনে
পড়ে।
রেশোবা গ্রামে তার বৃদ্ধ অন্ধ বাবাও এমনিভাবে বাড়ির বাইরে বসে থাকে। সেকথা
মনে হতেই সে মীর আলিকে সালাম দেয়।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
পাঠকসমাজে বিপুল জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে
দেশ, দেশের মানুষ, ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতি। '১৯৭১' তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাবলির
মধ্যে অন্যতম। এ উপন্যাসের শুরুতে নীলগঞ্জ গ্রামের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে গ্রামটিকে
আবহমান বাংলার আর দশটা সাধারণ গ্রামের মতোই মনে হয়। তবে গ্রামে পাকিস্তানি মিলিটারি
প্রবেশ করার পর থেকে ধীরে ধীরে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।
নীলগঞ্জ গ্রামের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক একে দরিদ্র, শ্রীহীন, ত্রিশ-চল্লিশ
ঘরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ বলেছেন। বিস্তীর্ণ জলাভূমি গ্রামটিকে কান্তের মতো দুইদিকে
ঘিরে আছে। কৃষিকাজ করেই মূলত এখানকার লোকজনের জীবিকার সংস্থান হয়। গ্রামের অধিকাংশ
ঘরেই খড়ের ছাউনি। সম্প্রতি কয়েকটি টিনের ঘর হয়েছে। বদিউজ্জামানের মতো হাতেগোনা দুই-একজন
কাজের জন্য গ্রামের বাইরে যায়। গ্রামে একটি মসজিদ ও একটি, প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। এলাকার
বাইরের মানুষ বলতে মসজিদের ইমাম সাহেব ও স্কুল মাস্টার আজিজুর রহমান মল্লিক। গ্রামের
সাধারণ জনগণের বাইরে নীলগঞ্জের জলাভূমিটার পাশে একদল কৈবর্ত বসবাস করে। গ্রামের সঙ্গে
অবশ্য তাদের খুব একটা সংযোগ নেই। মাছ ধরার সিজনে এরা জলমহালে মাছ ধরতে যায়। আবার ফিরে
আসে।
এ রকম একটা গণ্ডগ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করার পরই নিস্তরঙ্গ গ্রামটিতে ভিন্ন
ধরনের কান্ডকারখানা ঘটতে থাকে। মসজিদের ইমাম সাহেব ও আজিজ মাস্টারকে বন্দি করে মেজর
এজাজের নেতৃত্বে নির্যাতন শুরু করা হয়। আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতে চিত্রা বুড়ির ছেলে
হত্যার বিচারের নামে মনা ও তার ছোটোভাইকে ইমাম ও মাস্টারের সামনে গুলি করে হত্যা করা
হয়। মিলিটারিরা হত্যা করে সেনবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী নীলু সেনকেও। সফদরউল্লাহর
বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রী ও শ্যালিকার উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় মিলিটারিরা। অথচ এদের
কারো সাথে মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্কই ছিল না।
উপরের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, নীলগঞ্জ গ্রামের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক
না থাকলেও মেজর এজাজের নেতৃত্বে থাকা মিলিটারি দলটি ভাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে গ্রামটিকে
যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। ফলে উপন্যাসের নীলগঞ্জ গ্রাম আর সাধারণ একটি গ্রাম হয়ে
থাকেনি-মুক্তিযুদ্ধের একটি জলজ্যান্ত ছবি হয়ে উঠেছে।
ক) খুনের বিচার করতে মেজর এজাজ এতটা আগ্রহী হয়েছিল কেন?
খ) 'নীলগঞ্জ আসলে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।' ব্যাখ্যা
করো।
ক) নম্বর প্রশ্নের উত্তর
নিজেকে ন্যায়বিচারক হিসেবে দেখানোর পাশাপাশি গ্রামবাসীর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে
মেজর এজাজ খুনের বিচার করতে আগ্রহী হয়েছিল।
'১৯৭১' উপন্যাসে নীলগঞ্জ গ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করার পর স্থানীয় মসজিদের ইমাম
ও স্কুল মাস্টারকে ডেকে এনে নির্যাতন করে মেজর এজাজ। তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো
উপায়ে গ্রামের মানুষকে ভড়কে দেওয়া। এ কাজে সে সামনে নিয়ে আসে মুক্তিবাহিনীর হাতে তার
বন্ধু মেজর বখতিয়ারের বন্দি হওয়ার কাহিনি, যার সাথে নীলগঞ্জ গ্রামের মানুষের কোনো সম্পর্ক
নেই। তখনই তার সামনে এসে যায় চিত্রা বুড়ির ছেলে হত্যার প্রসকাটি। কৈবর্তপাড়ার ঘটনায়
অন্যরা সাধারণত নাক গলায় না- এই সুবাদে সে নিজেকে ন্যায়বিচারক হিসেবে দেখাতে খুনের
দায়ে মনা কৈবর্তকে নির্মমভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্তরালে মূলত সে গ্রামবাসীর মনে চরম আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে
চেয়েছে।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী হুমায়ূন আহমেদ।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক '১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ পটভূমিতে ১৯৭১ সালের মহান
মুক্তিযুদ্ধের একটি আলেখ্য রচনা করেছেন। অন্য আর দশটি সাধারণ অজগ্রামের মতোই '১৯৭১'
উপন্যাসের নীলগঞ্জ গ্রাম। নীলগঞ্জের মানুষের জীবনযাত্রায় রাজনীতির কোনো ছোঁয়া না লাগলেও
পাকিস্তানি মিলিটারি প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে গ্রামটি যেন একখণ্ড যুদ্ধের ময়দানে পরিণত
হয়।
ত্রিশ-চল্লিশটি পরিবারের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ নীলগঞ্জ। বিস্তীর্ণ জলাভূমি গ্রামটি
কান্তের মতো দুদিকে ঘিরে আছে। এখানকার প্রায় সকলেই কৃষিকাজ করে। শীতকালে প্রচুর রবিশস্য
ফলে এখানে। গ্রামের ঘরবাড়িও অতি সাধারণ।
এ রকম একটি গ্রামেই একদিন ভোর হতে না হতেই মেজর এজাজের নেতৃত্বে মিলিটারি প্রবেশ
করে। প্রথমেই তাদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হন ইমাম সাহেব ও আজিজ মাস্টার। ন্যায়বিচার
প্রতিষ্ঠার প্রহসন করে মনা কৈবর্ত এবং তার ছোটো ভাইকে ইমাম ও আজিজ মাস্টারের সামনে
গুলি করে হত্যা করে। এর মাধ্যমে পুরো গ্রামে একটা অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চায় সে।
মাস্টারকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা, নীলু সেনকে হত্যা করা, সফদরউল্লাহর স্ত্রী ও শ্যালিকার
উপর পাশবিক নির্যাতন করা ইত্যাদির মাধ্যমে মিলিটারিরা পুরো গ্রামটিকেই যুদ্ধক্ষেত্রে
পরিণত করে।
উপরের আলোচনায় নীলগঞ্জ গ্রামের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই এমনটি আসলে মুক্তিযুদ্ধকালীন
সমগ্র বাংলায় চিত্রিত হয়েছে। বাঙালি তরুণ রফিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশের
অনেক তরুণ। তাই বলা যায়, নীলগঞ্জ আসলে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
ক) অনুফা কে? সে কেন মীর আলির উপর বিরক্ত হয়?
খ) 'অকারণ নিপীড়নই একটি যুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত করেছিল।'-
'১৯৭১' উপন্যাস থেকে অন্তত তিনটি চরিত্রের উদাহরণ দিয়ে প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
অনুফা মীর আলির বড়ো ছেলে বদিউজ্জামানের স্ত্রী। গ্রামে মিলিটারির আতঙ্ক ছড়িয়ে
পড়ায়, ভীত-সন্ত্রস্ত পরিবেশেও বারবার খাবার খেতে চাওয়ায় সে মীর আলির উপর বিরক্ত হয়।
গ্রামে মিলিটারি আসার পর নীলগঞ্জের মানুষের জীবনে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মসজিদের
ইমাম ও স্কুলের শিক্ষক আজিজ মাস্টারের উপর নির্যাতন করে মিলিটারিরা। বিচারের নামে মনা
কৈবর্তকে হত্যা করে। নীলু সেনকে তার বাড়িতেই হত্যা করা হয়। সফদরউল্লাহর স্ত্রী ও তার
ছোটো বোনদের উপর পাশবিক নির্যাতন করে মিলিটারিরা। এমন ভীতিকর অবস্থায় বদিউজ্জামানও
বাড়িতে ফেরেনি। তাই অনুফা অনেক বেলা হয়ে গেলেও রান্না করেনি। এদিকে খাবারের জন্য মীর
আলি কাঁদে। বারবার তাড়া দেয় অনুফাকে। ফলে অনুফা তার শ্বশুর মীর আলির উপর অত্যন্ত বিরক্ত
হয়।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম হুমায়ূন আহমেদ। দেশবিভাগ
পরবর্তী সময়ে তিনি বাঙালি পাঠককে বইমুখী রাখতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। '১৯৭১' উপন্যাসটি
তাঁর কৃতিত্বের অন্যতম স্বাক্ষর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসে
তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নীলগঞ্জের মতো একটি গণ্ডগ্রামও পাকিস্তানি মিলিটারিদের অত্যাচার-নির্যাতনের
কারণে মুক্তিযুদ্ধের এক টুকরা রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। '১৯৭১' উপন্যাসের আজিজ মাস্টার,
সফদরউল্লাহ ও রফিক চরিত্রের উদাহরণে প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করা হলো-
আজিজ মাস্টার: আজিজ মাস্টার হলেন নীলগঞ্জ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।
স্কুল মাস্টারির পাশাপাশি তিনি কবিতা লেখেন। তার কবিতাগুলো মূলত জয়নাল মিয়ার কিশোরী
কন্যা মালাকে নিয়ে। মিলিটারি কমান্ডার মেজর এজাজ ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুষিক
অত্যাচার-নির্যাতন করে। মালার প্রতি তার দুর্বলতার কথা জানতে পেরে উলঙ্গ অবস্থায় তাকে
মালার সামনে নিতে চায় মেজর এজাজ। তখন তিনি নিজেই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুকে বেছে নেন।
সফদরউল্লাহ: সফদরউল্লাহ '১৯৭১' উপন্যাসের একটি অপ্রধান চরিত্র। একদিন মিলিটারিরা
তার বাড়িতে এসে তাকে না পেয়ে তার স্ত্রী ও শ্যালিকার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতে
সে মিলিটারির প্রতি চরম ক্ষুদ্ধ হয়ে দা হাতে নিয়ে দায়ী মিলিটারিকে খুঁজতে থাকে প্রতিশোধ
নেওয়ার জন্য।
রফিক: রফিক এ' উপন্যাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মিলিটারি কমান্ডার মেজর
এজাজের সহযোগী হিসেবে নীলগঞ্জ গ্রামে প্রবেশ করলেও এক পর্যায়ে তিনি নিজেকে একজন প্রকৃত
স্বদেশপ্রেমী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শুরুতে মেজর এজাজের দোভাষী হিসেবে কাজ করলেও
চোখের সামনে অহেতুক অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড দেখে তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে
ফেলেন- এসব অন্যায়, তাই পরিত্যাজ্য। ফলে মেজর এজাজের সাথে শুরু হয় তাঁর কথার যুদ্ধ।
শেষ পর্যন্ত স্বজাতির প্রতি ভালোবাসার মূল্য তাঁকে নিজের জীবন দিয়ে চুকাতে হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, আজিজ মাস্টার, সফদরউল্লাহ, রফিক- এরা কেউই মুক্তিযুদ্ধের সাথে
প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। মেজর এজাজ কল্পিত শত্রু তথা মুক্তিবাহিনী খোঁজার নামে
একে একে সবাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের মুক্তিযুদ্ধের অংশ বানিয়ে
দেয়। তাই বলা যায় যে, 'অকারণ নিপীড়নই একটি যুদ্ধকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত করেছিল।'
ক) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের প্রভাব '১৯৭১'
উপন্যাসের আলোকে সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
খ) 'মিলিটারিরা মুসলমানদের ক্ষতি করে না'- গ্রামবাসীর এহেন বিশ্বাস
যে কতটা ভ্রান্ত ছিল; তার পরিচয় '১৯৭১' উপন্যাসের আলোকে বিশ্লেষণ করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃতি মুক্তিবাহিনী
ও সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছিল। হুমায়ূন আহমেদের '১৯৭১' উপন্যাসে দেখানো
হয়েছে নীলগঞ্জ গ্রামের পরিবেশ-ও জনজীবন। বাংলাদেশের অন্য গ্রামের মতো এ গ্রামও সাধারণ।
এখানকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যও একই রকম। উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মুক্তিবাহিনীরা ঘন জঙ্গলে
আশ্রয় নিয়েছে ফলে পাকিস্তানিরা তাদের ধরতে পারছে না। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সময়
অনেক মুক্তিবাহিনী ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করত। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে অনেক
ডোবা, জাল ও পুকুর ছিল। সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে অনেক সময় উপন্যাসের বদিউজ্জামানের মতো
পুকুরে কেরল নাক ভাসিয়ে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকত। গ্রামের রাস্তাঘাট সরু ও কর্দমাক্ত হওয়ায়
অনেক সময় সেনাবাহিনীরা প্রবেশ করতে পারত না। এছাড়া উপন্যাসে বলা আছে কালবৈশাখি ঝড়ের
কথা। ঝড়ের কারণে সেনাবাহিনীরা অপারেশন করতে ব্যর্থ হত, ফলে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে
সরে যেতে পারত।
'১৯৭১' উপন্যাসে লেখক মুক্তিযুদ্ধে ঋতু ও পরিবেশের প্রভাব বেশ সার্থকভাবেই রূপায়ণ করেছেন।
খ) নম্বর প্রশ্নের উত্তর
হুমায়ূন আহমেদের সুনিপুণ সাহিত্যশৈলীর দিকটি উন্মোচিত হয়েছে '১৯৭১' উপন্যাসে।
'১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি বাহিনী ও সাধারণ
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এই উপন্যাসে তিনি মিলিটারি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা
তুলে ধরেছেন।
আলোচ্য উপন্যাসে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মুসলিম ধর্মের হওয়ায় তাদের সম্পর্কে
গ্রামবাসীর প্রথমদিকে ইতিবাচক ধারণা ছিল। তবে মিলিটারিদের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে
গ্রামবাসীর এই বিশ্বাস ভাঙতে বেশি সময় লাগে না। অচিরেই তারা বুঝে যায় মিলিটারিদের কাছে
বাঙালি জাতির হিন্দু-মুসলমান সবাই একই। তারা মূলত বাঙালিবিদ্বেষী।
'১৯৭১' উপন্যাসে গ্রামের লোক হানাদার বাহিনী সম্পর্কে লোক মুখে নানা গল্প শোনে।
অনেকেই তাদের সাথে যুক্ত হয় রাজাকার হিসেবে। মেজর এজাজ মীর আলিকে সালাম দেওয়ায় এবং
কেবল হিন্দুদের গুলি করে মারায় গ্রামবাসীর ধর্মভিত্তিক বিশ্বাস আরও প্রকট হয়। জয়নাল
মিয়া সফদরউল্লাহসহ বাকি লোকদের আশ্বস্ত করে যে, মিলিটারিরা মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করে
না, ভালো ব্যবহার করে, মেয়েদের সম্ভ্রমহানি করে না। তাই গ্রামের লোকদের ভয়ের কোনো কারণ
নেই।
তবে তাদের এই বিশ্বাস অতি অল্প সময়ের মধ্যে বালির বাঁধের মতো ভাঙতে সময় নেয়নি।
মিলিটারি সুবেদারের হাতে সফদরউল্লাহর স্ত্রী ও শ্যালিকা নির্যাতনের শিকার হলে সকলের
ধারণা বদলে যায়। ইমাম সাহেবকে মুক্তিযোম্বাদের তথ্য পাওয়ার জন্য মেরে রক্তাক্ত করলে
সাধারণ মানুষের পাকিস্তানিদের উপর থেকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস উঠে যায়। কারণ পাকিস্তানিরা
মসজিদের ইমামকেও প্রহার করতে বাদ দেয় না। ওজুর পানি দেয় না নামাজ পড়তে। এছাড়া আজিজ
মাস্টারকে নৃশংসভাবে সম্ভ্রমহানি ও হত্যা করে। জয়নাল মিয়াকে ধরে এনে তার মেয়েদের নিয়ে
ভয়ভীতি দেখায়। অথচ আজিজ মাস্টার, ইমাম সাহেব, জয়নাল, নিজাম, সফদরউল্লাহর স্ত্রী এবং
শ্যালিকা সকলেই জাতিতে মুসলিম ছিল। তবুও তারা কেউ মিলিটারির আগ্রাসি থাবা থেকে বাঁচতে
পারেনি। মিলিটারিদের কাছে ধর্মীয় সহানুভূতির কোনো স্থান ছিল না। সকল বাঙালিদেরই তারা
ঘৃণা করত এই বিষয় গ্রামবাসী দ্রুতই বুঝতে পারে।
সবশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিজস্ব কোনো বিবেক-বিবেচনা,
ধর্মবোধ ছিল না। তাঁরা নিজেদের সৃষ্টি করা বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে হিন্দু-মুসলিম সকল বাঙালির
জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
ক) মেজর এজাজ আহমেদ তার সহযোগী রফিককে চিনতে পারল না কেন? ব্যাখ্যা
করো।
খ) পাকিস্তানি শাসনামলে জাতিগত বিদ্বেষের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে
'১৯৭১' উপন্যাসের মধ্য দিয়ে, তার স্বরূপ ব্যাখ্যা করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
'১৯৭১' উপন্যাসে মেজর এজাজ আহমেদ এবং তার সহযোগী রফিকের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের
সময়ের জটিল পরিস্থিতি এবং মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনকে তুলে ধরে। রফিক ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।
রফিকের দেশপ্রেমের কারণে মেজর এজাজ তাঁকে চিনতে পারেনি। উপন্যাসের সবচেয়ে জটিল চরিত্র
রফিক। রফিক মেজর এজাজের সহযোগী হিসেবে নীলগঞ্জ গ্রামে আসেন। মেজর এজাজের নির্দেশে গ্রামে
স্থানীয় মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জানতে তিনিও কৌতূহলী হয়ে ওঠেন কিন্তু তিনি মেজরের বিভিন্ন
পদক্ষেপে বাধা দিতে থাকেন। রফিকের সমালোচনা ও বাধা দেওয়া মেজর এজাজের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে
তোলে। মেজর এজাজ বুঝতে পারে তার সহযোগী একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য। মেজর তাই রফিককে
জলাভূমিতে পাঠায় এবং দুইজন মিলিটারিকে নির্দেশ দেয় রফিককে গুলি করার জন্য। রফিক মৃত্যু
নিশ্চিত জেনেও রক্তিম সূর্যের মতো জলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। রফিকের পরিবর্তন মেজরকে
দুশ্চিন্তায় ফেলে। তার মনে হয় এ যেন এক অন্য রফিক। এ রফিককে সে আগে কখনো দেখেনি। এ
রফিক যেন ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ধারক ও বাহক। তাই বলা যায়, ১৯৭১ উপন্যাসের রফিক একজন
দেশপ্রেমিক ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের রক্ষার কৌশল ছিল
খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, যা ছিল মেজর এজাজের কাছে অপ্রত্যাশিত।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
যে উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, তার সম্ভাবনা শুরুতেই হোঁচট খায়
ভাষার প্রশ্নে। এরপর ভাষাগত পার্থক্যের পথ ধরে দেশটির আঞ্চলিক দূরত্ব এগোতে থাকে নানাবিধ
বৈষম্যের দিকে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক এককেন্দ্রিকতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য
পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আরও বিপন্ন করে তোলে। পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি দিনে দিনে
আত্মগরিমায় রূপ নিতে থাকে। বাঙালিদের দেখতে থাকে নীচ হিসেবে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের
মধ্যে জাতিগত উন্নাসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিপীড়িত পূর্বাঞ্চল যখন নিজেদের অস্তিত্ব
রক্ষায় ঘুরে দাঁড়াতে যায়, তখন সে টের পায়, তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-বৈষম্যের মতোই
আরেকটি উপাদান পদানত করে রেখেছে। তার নাম
জাতিগত বিদ্বেষ। যার চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। '১৯৭১' উপন্যাসের
লেখক তারই একটি স্বরূপ তুলে ধরেছেন নীলগঞ্জে আগত পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্য দিয়ে।
'১৯৭১' উপন্যাসে লেখক নীলগঞ্জ নামক একটি সাধারণ গ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে
দেখাতে চেয়েছেন। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল এসে যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে
দেয়। দলটির অধিনায়ক মেজর এজাজ। লেখক মেজর এজাজকে এখানে উপস্থিত করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের
শাসকদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে। তার ভাষা, চিন্তা, কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠীর সম্মিলিত চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
রফিকের সাথে মেজর এজাজের কথোপকথনে ফুটে ওঠে তার গোষ্ঠীগত চেতনার স্বরূপ। এজাজ
এ দেশের মানুষদের ভীরু, কাপুরুষ, বেইমান হিসেবে বিশেষিত করে। এ দেশের মুসলমানরা তার
চোখে পুরোপুরি মুসলমান নয়। ধর্মীয় সমতার ধারণা এখানে ভেঙে পড়ে। সে এ অঞ্চলের মুসলমানদের
চিহ্নিত করে আধা-হিন্দু হিসেবে। হিন্দুদের প্রতি রয়েছে তার জাতিগত বিদ্বেষ। হিন্দুদের
মূর্তি নিয়ে তার মন্তব্যে ঝরে পড়ে তাচ্ছিল্য। এ অঞ্চলের নারীদের প্রতি তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি
তীর্যকভাবে প্রকাশ পায়। উপন্যাসের কাহিনির অগ্রগতির সাথে এ দেশের মানুষকে মানুষ মনে
করাই তার জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে। এ অঞ্চলের মানুষের মান-অপমান থাকা তার বিশ্বাসের বাইরে
মনে হয়। সে মূলত এ দেশের মানুষদের বিশ্বাসেরই যোগ্য মনে করে না। ইমাম সাহেব, আজিজ মাস্টার,
জয়নালের মতো নীলগঞ্জের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিরা তার কাছে ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এমনকি
তাদের সাহায্যে নিবেদিত রাজাকাররা ভালো মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হলেও ওঠা-বসা কিংবা
মেলামেশার ক্ষেত্রে এ এ দেশের অধিবাসী হিসেবে নিচু দৃষ্টিভঙ্গির আওতায়ই থেকে যায়। এর
সবকিছুর পিছনে যুদ্ধের বাহ্যিক আয়োজনের সাথে কাজ করে পাকিস্তানিদের জাতিগত অহংকার।
সবশেষে বলা যায়, '১৯৭১' উপন্যাসের নীলগঞ্জের মধ্য দিয়েই দেখা যায় পুরো পূর্ব
পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে। আর মেজর এজাজের চিন্তা ও কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সামগ্রিক চেতনা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের
বাইরে-জাতিগত বিদ্বেষের একটি স্বরূপ ফুটে ওঠে উপন্যাসের এজাজসহ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর
কর্মকাণ্ড ও চিন্তার মধ্যে।
ক) 'বিপদের সময় নিজ গোত্রের মানুষের কথাই প্রথম মনে পড়ে।'- বলতে
কী বোঝানো হয়েছে?
খ) 'কৈবর্তপাড়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ আগুন শুধু
কৈবর্তপাড়ায় নয়, সারা বাংলাদেশজুড়ে জ্বলেছে।'- কথাটি তোমার নিজের ভাষায় বিশ্লেষণ করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
গ্রামে মিলিটারি আসার পর চিত্রা বুড়ির সবার আগ্নেকৈবর্তপাড়ায় খবর দেওয়ার কথা
মনে হয়। ঝুড়ির ছেলে খুন হওয়ার পর থেকে সে কৈবর্তপাড়ায় না থাকলেও বিপদের সময় তার নিজ
গোত্রের মানুষের কথা মনে পড়েছে।
'১৯৭১' উপন্যাসে নীলগঞ্জ গ্রামে যখন মিলিটারি আসে, তখন মিলিটারিদের দেখে গ্রামের
বিভিন্ন মানুষের মনোভাব লেখক সুনিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন। সেসময় চিত্রা বুড়ি নীলু সেনের
বাড়ির কালীমন্দিরে বসে কালীমূর্তির সাথে আপন মনে কথা বলছিল। তারপর সে কালীমূর্তিকে
জোড়া পাঁঠার আশ্বাস দিয়ে ঘুমাতে যায়। কিন্তু মিলিটারিদের গ্রামে ঢোকার শব্দে বুড়ির
ঘুম ভেঙে যায়। বুড়ি ভয় পেয়ে ভাবে হয়তো ডাকাত এসেছে। সে অন্ধকারের মধ্যে দেখে তারা দল
বেঁধে যাচ্ছে। সেই সাথে বিভিন্ন জায়গায় টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে স্কুলঘরের দিকে আগাচ্ছে।
তখন বুড়ি আজিজ মাস্টারকে খবর দেওয়ার কথা ভাবলেও পরক্ষণেই ভাবে যে, সবার আগে খবর দেওয়া
দরকার কৈবর্তপাড়ায়, কৈবর্তরা বুড়ির ছেলের খুনের বিচার না করায় তাদের উপর বুড়ির ক্ষোভ
ছিল। এমনকি তারা বুড়িকে তাদের পাড়ায়ও থাকতে দেয়নি। তবুও বুড়ি সবার আগে নিজ গোত্রের
মানুষদের এই আসন্ন বিপদের কথা জানানোর কথা ভাবে।
প্রকৃতপক্ষে, মানুষ কখনো তার শিকড় ভুলতে পারে না। এ কারণেই শত রাগ-অভিমান সত্ত্বেও
বিপদের সময় চিত্রা বুড়ির প্রথমে নিজ গোত্রের মানুষের কথা মনে পড়ে।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
হুমায়ূন আহমেদ রচিত '১৯৭১' উপন্যাসে কৈবর্তপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন আহত
সৈন্য আশ্রয় নিয়েছিল এমন ধারণায় পাকিস্তানি বাহিনী কৈবর্তপাড়া জ্বালিয়ে দেয়। সেই আগুনের
লালচে আভায় দেখা যায় রফিকের দৃপ্ত মুখ। চিত্রা বুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। অন্ধ মীর
আলি আগুন দেখতে পেয়ে চিৎকার করে। গ্রামের মানুষ বের হয়ে আসে। লেখক এমন বর্ণনার মধ্য
দিয়ে ইঙ্গিতে পুরো বাংলাদেশকেই তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে যে আগুন কৈবর্তপাড়ায় জ্বলছে,
তার আঁচেই যেন পুড়ছিল বাংলাদেশ। এই আগুনই নীলগঞ্জের মতো বাংলাদেশকে পুড়িয়ে ভস্ম করে
তুলেছিল।
মেজর এজাজের সম্মুখে সন্ত্রস্ত জয়নাল মিয়া জঙ্গলায় আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের
সাথে কৈবর্তপাড়ার সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ করে। এমতাবস্থায় মেজর এজাজ কৈবর্তপাড়া জ্বালিয়ে
দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যদিও কৈবর্তরা তার পূর্বেই নিরাপদে অন্যত্র সরে পড়ে। কৈবর্তপাড়া
যখন জ্বলছিল, লেখকের বর্ণনায় তখন এক. নাটকীয়তার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। লেখক কৈবর্তপাড়ার
আগুনের মধ্য দিয়ে যেন পুরো বাংলাদেশকে দেখাতে চেয়েছেন। সেই আগুনের আভায় রফিকের দৃপ্ত
বক্তব্যের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন নিকটবর্তী প্রতিরোধের সংকেত।
মুক্তিযুদ্ধটা ছিল বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়া
এক অন্যায় যুদ্ধ। এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আতঙ্ক নিয়ে আসে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী। তাদের জুলুম, নির্যাতন, হত্যা নিপীড়নের শিকার হয় এ দেশের নিরীহ মানুষ।
পাকিস্তানি বাহিনী এ অঞ্চলে যে আগুন জ্বালায়, তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। সমগ্র বাংলাদেশকেই
তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। বাংলাদেশের সমগ্র মানুষকে করে তোলে প্রতিপক্ষ। বৃহৎ
পরিসরের এই ঘটনাকেই লেখক দেখিয়েছেন নীলগঞ্জের প্রতীকে। পুরো বাংলাদেশই যেন হয়ে উঠেছে
কৈবর্তপাড়া।
নীলগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন, হত্যা ও তাণ্ডবের পর কৈবর্তপাড়া জ্বালিয়ে
দৈওয়ার ফলস্বরূপ নীলগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার ইঙ্গিত
পাওয়া যায়। রফিক দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন সেই বার্তা। মেজর এজাজের এ দেশ থেকে জীবিত ফিরে
যেতে পারার যে অনিশ্চয়তার ঘোষণা রফিক মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে দিয়ে যান, সেখানেই লুকিয়ে
আছে নীলগঞ্জ তথা বাংলাদেশের প্রতিরোধ যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সংকেত।
ক) 'আমি নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখাতে চাই।' মেজর এজাজ কেন এ কথা বলেছিল?
'১৯৭১' উপন্যাসের আলোকে ব্যাখ্যা করো।
খ) '১৯৭১' উপন্যাসের মূল উপজীব্য হলো মুক্তিযুদ্ধে নিপীড়িত সাধারণ
মানুষের জীবন-যন্ত্রণা।'- আলোচনা করো।
(ক) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
মেজর এজাজ পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে গ্রামের মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার
ইচ্ছা স্পষ্ট করার জন্য প্রশ্নোক্ত কথাটি বলে। '১৯৭১' উপন্যাসে নীলগঞ্জ গ্রামের চিত্রা
বুড়ির ছেলে কৈবর্ত পাড়ায় খুন হয়। চিত্রা বুড়ি মেজর এজাজকে খুনের বিষয়ে বিচার দেয়। সে
চিত্রা বুড়ির ছেলে হত্যার বিচার করার সুযোগটি সাগ্রহে গ্রহণ করে। প্রথমেই সে কৈবর্তপাড়ার
মনা এবং তার ছোটো ভাইকে ধরে নিয়ে আসে। সে খুনের অপরাধ স্বীকার করে নেয়। এরই সূত্র ধরে
মেজর এজাজ তাকে গুলি করে হত্যা করার মতে এক নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নেয়। তার নির্দেশে মনা
এবং তার ছোটো ভাইকে বিলের পানিতে দাঁড় করানো হয়। মনার এগারো বছরের ভাইটির জন্য রফিকের
মায়া হয়। রফিক ছোটো ভাইটিকে হত্যা করার বিরোধিতা করেন। এতে মেজর এজাজ আরও অত্যাচারী
কন্ঠে বলে, এ অঞ্চলে সে নিষ্ঠুরতার একটা নমুনা দেখাতে চায়। মেজর এজাজ মনে করে তার নিষ্ঠুরতা
গ্রামের মানুষ দেখলে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরোধিতা করার সাহস পাবে না। তাই সে গ্রামে
নিষ্ঠুরতার একটি নমুনা দেখাতে তৎপর হয়ে পড়ে।
(খ) নম্বর প্রশ্নের
উত্তর
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি নান্দনিক লেখনীর
মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনবাস্তবতা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'১৯৭১' শীর্ষক উপন্যাসও এর ব্যাতিক্রম নয়। এই উপন্যাসে লেখক বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনাপ্রবাহের
মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিপীড়িত সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
'১৯৭১' উপন্যাসে দেখা যায় নীলগঞ্জ গ্রামের সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষেরা বিভিন্নভাবে
পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী দ্বারা নির্যাতন ও নিষ্পেষণের স্বীকার হয়। উপন্যাসের প্রথম
দিকে দেখানো হয় অন্ধ মীর আলিকে। ছেলের পরিবারে সে খুব সাধারণ জীবনযাপন করত। কিন্তু
মিলিটারি আসার পর থেকেই তার জীবনপ্রবাহ হঠাৎ করে বদলে যায়। তার ছেলে বদি মিলিটারির
ভয়ে পালিয়ে থাকায় তার খোঁজ পাওয়া যায় না। ছেলের মৃত্যুর আশঙ্কা, গ্রামে বিচরণশীল মিলিটারির
তাণ্ডব, ক্ষুধার যন্ত্রণা তার জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
নীলগঞ্জের ইমাম সাহেব অন্য অঞ্চল থেকে এসে এখানে ইমামতি করেন। পাকিস্তানিরা
আসার পর তাকে স্কুলঘরে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর তথ্য জানতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তিনি
বিপর্যস্ত নির্মম পরিস্থিতির শিকার হন। চোখের সামনে চেনা মানুষদের মৃত্যু তার মাঝে
ভীতি সঞ্চার করে। গ্রামের আজিজ মাস্টার সাধারণ একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক। অন্য এলাকা
থেকে এখানে এসে জীবিকানির্বাহ করে থাকেন। তাকেও মিলিটারিরা আটকে রেখে তথ্য বের করতে
মানসিক নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানি করে। আজিজ মাস্টার এতটাই যন্ত্রণা
পেয়েছিলেন যে লজ্জা ও মৃত্যুর মধ্যে তিনি মৃত্যুকে বরণ করেন।
উপন্যাসের সফদরউল্লাহ গ্রামের সাধারণ কৃষক। পরিবার নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করছিল।
কিন্তু মিলিটারিরা তার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে নির্যাতন করলে তার জীবনে অসহনীয় ঝড় ওঠে।
সে হাতে দা নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শত্রুর সন্ধানে।
পরিশেষে বলা যায় যে, '১৯৭১' উপন্যাসের মূল উপজীব্য হলো পাকিস্তানিরা কীভাবে
সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্য ও তার দোসরদের অগ্নিসংযোগ,
হত্যা, ধর্ষণ নীলগঞ্জ গ্রামের সাধারণ মানুষদের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।

Social Plugin