এসএসসি - বাংলা ১ম পত্র - জীবন বিনিময় ( কনসেপ্ট )

 


জীবন বিনিময়

গোলাম মোস্তফা

মৌলিক আলোচনা

কবি-পরিচিতি:

জন্ম: গোলাম মোস্তফা যশোর জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন: তিনি ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।

কর্মজীবন: কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

রচনার বৈশিষ্ট্য: কাব্য, উপন্যাস, জীবনী, অনুবাদ সহ ইত্যাদিসাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা ছিল। কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে ইসলামি ঐতিহ্য থেকে তিনি প্রেরণা লাভকরেছিলেন। তাঁর কবিতার ভাষা সাবলীল ও ছন্দ গতিশীল

উল্লেখযোগ্য রচনাবলি: কাব্য: রক্তরাগ, খোশরোজ, বুলবুলিস্তান, কাব্যকাহিনী, সাহারা, হাস্নাহেনা, বনি আদম।

উপন্যাস: ভাঙ্গাবুক, রূপের নেশা, এক মন এক প্রাণ।

মৃত্যু: তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

কবিতার মূলভাব:

কবিতাটিতে পিতৃস্নেহের একটি মহৎ দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছে। পিতার স্নেহ-বাৎসল্যের কাছে মৃত্যুর পরাজয় এই কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয়। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি পিতার অপরিসীম ভালোবাসা ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে কবিতাটিতে।

 

কবিতার সার-সংক্ষেপ:

জীবন বিনিময়' কবিতাটি গোলাম মোস্তফা রচিত 'বুলবুলিস্তান' কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। বিজ্ঞ চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এক দরবেশ এসে জানালেন যে সম্রাট যদি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ধন দান করেন তবেই তাঁর পুত্র জীবন লাভকরতে পারেন। সম্রাট বাবর উপলব্ধি করলেন নিজের প্রাণের চেয়ে আর বেশি প্রিয় কিছু নেই। তিনি বিধাতার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সে ধনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। এভাবে পিতৃ স্নেহের কাছে মৃত্যুর পরাজয় ঘটল।

 

চলো সহজভাবে কবিতার অর্থ বুঝি:

লাইন ১: বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর-

পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!

চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।

 রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম কবিরাজ দরবেশ এ

সেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,

 সেবাযত্নের বিধিবিধানের ত্রুটি নাহি এক লেশ।

ব্যাখ্যা: মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। দুশ্চিন্তায় বাবরের নির্ঘুম সময় যায় কারণ তাঁর পুত্রের চারপাশে মরণ-অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। রাজ্যে যত চিকিৎসক, বিজ্ঞ, হাকিম ছিল সবাই বিশেষভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের সেবাযত্নে কোনো ত্রুটি ছিল না।

 

লাইন ২: তবু তাঁর সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,

যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়-

জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়।

শুধাল বাবর ব্যগ্রকণ্ঠে ভিষকবৃন্দে ডাকি,

'বল বল আজি সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,

এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?'

ব্যাখ্যা: হুমায়ুন এমন এক জটিল রোগে আক্রান্ত যা প্রতিকার করা সম্ভব ছিল না। দিন যত যাচ্ছিল তত তার দুর্ভোগ বেড়ে যাচ্ছিল। অস্তগামী সূর্যের মতো তার আয়ুও কমে আসছিল। তখন সম্রাট বাবর চিকিৎসকদের ডেকে সত্য ঘটনা জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আদৌ তার পুত্রের এ রোগ থেকে মুক্তি মিলবে কি'না।

 

লাইন ৩: নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা, 

মুখর হইয়া উঠিল তাঁদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা 

শেলসম আসি বাবরের বুকে বিঁধিল কিসের ব্যথা!

হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন-

'সুলতান, সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,

খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লা বাদশাজাদার প্রাণ।'

ব্যাখ্যা: সম্রাট বাবরের প্রশ্ন শুনে সকলে নিশ্চুপ হয়ে মাথা নত করে রইল। তাদের এ নীরবতা তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মত বাবরের বুকে বিদ্ধ হল। ঠিক সে সময় এক দরবেশ বলে উঠলেন বাবর যদি তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস দান করতে পারেন তাহলে আল্লাহতায়ালা খুশি হয়ে তার পুত্রের প্রাণ বাঁচিয়ে দিবেন।

 

লাইন ৪: শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি-

'তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,

সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে ধন জানি তাহা আমি জানি।'

 এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল

গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,

 প্রার্থনারত হাতদুটি তাঁর, নয়নে অশ্রুজল।

 কহিল কাঁদিয়া-'হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,

 মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ,

 তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।'

ব্যাখ্যা: দরবেশের কথা শুনে বাবর বলে, যদি তাই হয় তিনি জানেন তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কি এবং তা তিনি কোরবানি দিতে প্রস্তুত। এই বলে তিনি ঘরের মেঝেতে আসন পেতে গভীর ধ্যানে বসলেন এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে অশ্রুসিক্ত হয়ে হাত তুলে প্রার্থনা করলেন। যেন তাঁর প্রাণের বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা তাঁর পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দেন।

 

লাইন ৫: স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী গভীর

রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরাণী,

আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।

সহসা বাবর ফুকারি উঠিল-'নাহি ভয় নাহি ভয়,

প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়, পু

ত্র আমার বাঁচিয়া উঠিবে মরিবে না নিশ্চয়।

ব্যাখ্যা: চারিদিকে নিস্তব্ধ পরিবেশ, গভীর রাতে যেন আকাশে বাতাসে গোপন কোনো ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ বাবর চিৎকার করে বলে উঠেন সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রার্থনা কবুল করেছেন। তাঁর পুত্র এবার নিশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবে।

 

লাইন ৬: ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ

 নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,

তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস।

ব্যাখ্যা: আনন্দে সম্রাট বাবর তাঁর পুত্রের চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। রাতের অন্ধকার দূর হয়ে প্রভাতে আলো ফোটার মতো বাবরের নিরাশ হৃদয়েও আশার সঞ্চার হয়।

 

লাইন ৭: সেইদিন হতে রোগ-লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,

হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,

নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।

মরিল বাবর-না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?

মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোনো ক্ষয়,

পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!

ব্যাখ্যা: সেদিন হতেই সম্রাট বাবরের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগল। তিনি প্রফুল্ল চিত্তেই সে মরণ-শয্যাকে বরণ করে নিলেন। বিনিময়ে হুমায়ুন নতুন জীবন পেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। মৃত্যুবরণ করেও সম্রাট বাবর অমর হলেন। তিনি আসলে মৃত্যুকে জয় করেছেন। পিতৃস্নেহের কাছে মৃত্যুর পরাজয় ঘটেছে।

 

মূল বইয়ের শব্দার্থ ও টীকা

বিনিময়- বিনিময় বদল

সবচেয়ে শ্রেষ্ঠধন-  যে প্রত্যেক মানুষের কাছে নিজের জীবনই শ্রেষ্ঠ ধন হিসেবে বিবেচ্য।

নিদ- ঘুম

ধেয়ানে- ধানে।

ভিষকবৃন্দ - চিকিৎসকগণ।

সুপ্তিমগ্ন- ঘুমে অচেতন

বাদশাজাদা- সম্রাটের পুত্র, এখানে হুমায়ূন।

ফুকারি - চিৎকার করে।

শেলসম- তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো

কবুল- স্বীকার, গৃহীত।

শঙ্কা- ভয়

তিমির রাতের তোরণে উষার পূর্বাভাস- ভোরের আগমন আঁধার রাতের অবসান ঘোষণা করে। এখানে হুমায়ুনের মুমূর্ষু অবস্থা তিমির রাত এবং রোগমুক্তির লক্ষণকে উষার পূর্বাভাস বলা হয়েছে।

অস্তরবি- অস্তগামী সূর্য।

দৃপ্ত- উদ্ধত (এখানে উদ্দীপিত অর্থে ব্যবহৃত)।

 

অতিরিক্ত শব্দার্থ ও টীকা

লেশ- অত্যন্ত অল্প পরিমাণ।

দুরন্ত রোগ- প্রতিকার কষ্টসাধ্য এমন রোগ।

ব্যগ্রকণ্ঠ- আকুল কণ্ঠ।

নতমস্তক- মাথা নিচু করে আছে এমন।

হেনকাল- এমন সময়

এতেক - এতটুকু

গৃহতল- ঘরের মেঝে। ঘরের মেঝে। সমগ্র সৃষ্টি।

জয়োল্লাস- জয়ের আনন্দ।

হৃষ্টচিত্তে - আনন্দিত বা প্রফুল্ল চিত্তবিশিষ্ট