বাংলা ১ম পত্র - সেইদিন এই মাঠ ( কনসেপ্ট নোট )

 

সেইদিন এই মাঠ

জীবনানন্দ দাশ

মৌলিক আলোচনা

কবি পরিচিতি:

জন্ম: কবি জীবনানন্দ দাশ ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ। মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন একজন স্বভাবকবি।

শিক্ষা জীবন: জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল, ব্রজমোহন কলেজ ও কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষালাভ করেন। তিনি ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্ম জীবন: ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হয়। এক সময় তিনি সাংবাদিকতার পেশাও অবলম্বন করেছিলেন।

কবিতার বৈশিষ্ট্য: জীবনানন্দ দাশ প্রধানত আধুনিক জীবনচেতনার কবি হিসেবে পরিচিত। বাংলার প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে কবি নিমগ্নচিত্ত। কবির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এক অনন্য রূপসী। এ দেশের গাছপালা, লতাগুল্ম, ফুল-পাখি তাঁর আজন্ম প্রিয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতির রং ও রূপের বৈচিত্র্য প্রকাশ ঘটেছো অনেক অজানা গাছ, পশু-পাখি ও লতাপাতা তাঁর কবিতায় নতুন পরিচয়ে ধরা পড়েছে। প্রকৃতিপ্রেমিক এই কবি প্রকৃতি থেকেই তাঁর কবিতার রূপরস সংগ্রহ করেছেন।

সাহিত্যকর্ম: কবিতা ছাড়াও তিনি গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: বঝরা পালক, ধূসর পান্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, বেলা অবেলা কালবেলা, রূপসী বাংলা ইত্যাদি। প্রবন্ধ গ্রন্থ: কবিতার কথা। উপন্যাস: মাল্যবান, সুতীর্থ।

বিশেষ তথ্য: বুদ্ধদেব বসু তাঁকে 'নির্জনতম কবি' বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'চিত্ররূপময়' বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মৃত্যু: তিনি ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর তিনি কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন এবং ২২শে অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

 

কবিতার মূলভাব:

মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু এ জগতে সৌন্দর্যের মৃত্যু নেই, মানুষের স্বপ্নেরও মরণ নেই। গভীর জীবনতৃষ্ণা নিয়ে এই সত্যই কবিতাটিতে অনুভূত হয়েছে।

 

কবিতার সারসংক্ষেপ:

'সেইদিন এই মাঠ' কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে।

সভ্যতা একদিকে যেমন ক্ষয়িষ্ণু অন্যদিকে চলে তার বিনির্মাণ। মরণশীল ব্যক্তিমানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কিন্তু প্রকৃতিতে থাকে চিরকালের ব্যস্ততা। মাঠে থাকে চঞ্চলতা, চালতাফুলে পড়ে শীতের শিশির, লক্ষ্মীপেঁচকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মঙ্গলবার্তা, খেয়া নৌকা চলে নদীনালাতে। অর্থাৎ কোথাও থাকে না সেই মৃত্যুর রেশ। ফলে মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, পৃথিবীর বহমানতা মানুষের সাধারণ মৃত্যু রহিত করতে পারে না।

চলো সহজভাবে কবিতার অর্থবুঝি:

লাইন ১:

সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি-

এই নদী নক্ষত্রের তলে/সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন-

সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

ব্যাখ্যা: কবি সেই দিনের কথা কল্পনা করেছেন যখন তিনি আর এই পৃথিবীতে থাকবেন না। কিন্তু তখনও প্রকৃতি তার আপন রূপে বিদ্যমান থাকবে। রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশের নিচে এই নদী তখনও স্বপ্ন দেখে যাবে। প্রকৃতি তার বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষের স্বপ্ন ও সাধকে তৃপ্ত করে যাবে। প্রকৃতির বহমানতা ও মানুষের কল্পনাপ্রিয়তা কখনো শেষ হবে না।

 

লাইন ২:

আমি চলে যাব বলে

চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে

নরম গন্ধের ঢেউয়ে?

লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?

সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!

ব্যাখ্যা: কবি বলছেন, তিনি মৃত্যুবরণ করলেও প্রকৃতির যে নিত্যতা, তা শেষ হবে না। স্নিগ্ধ গন্ধের চালতাফুলের ওপর শিশিরের জল পড়ার যে নিত্যতা, তা কোনোকিছুর কারণেই থেমে যাবে না। লক্ষ্মীপেঁচা গভীর মমতায় তার আপন সুরে গান গেয়ে যাবে। কোনো একজন মানুষের অনুপস্থিতির কারণে প্রকৃতির আপন নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।

 

লাইন ৩:

চারিদিকে শান্ত বাতি ভিজে গন্ধ - মৃদু কলরব;

খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;

পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-

এশিরিয়া ধুলো আজ বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

ব্যাখ্যা: কবি সন্ধ্যার প্রকৃতির এক অনন্য রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। শীতকালে চারদিক যখন কুয়াশায় ঘেরা থাকে, নদীর ঘাটে তখন সারাদিন পরে কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা খেয়া নৌকার ভিড় জমে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মাঝে নৌকায় কুপি বাতি ধীরে ধীরে জ্বলতে থাকে। কবির মতে এ আলো খুবই শান্ত। নদীর বুক থেকে ভেসে আসা হিমশীতল বাতাস যেন ভেজা গন্ধ নিয়ে কবির মন ছুঁয়ে যায়। প্রকৃতির এই স্নিগ্ধতা নিত্য। এই জীবনবৈচিত্র্য চলমান থাকবে। কবি ব্যাবিলনীয় ও এশিরিয় সভ্যতার উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষের তৈরি সভ্যতাসমূহ কালের গর্ভে একদিন বিলীন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃতির যে চিরকালীন সৌন্দর্য, তা কখনোই শেষ হবার নয়।

মূলবইয়ের শব্দার্থ:

সেইদিন এই মাঠ... কবে আর ঝরে: জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি। প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্য তাঁর কবিতার মৌলিক প্রেরণা। তিনি জানেন বিচিত্র বিবর্তনের মধ্যেও প্রকৃতি তাঁর রূপ-রস-গন্ধ কখনই হারিয়ে ফেলবে না। তিনি যখন থাকবেন না তখনও প্রকৃতি তার অফুরন্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষের স্বপ্ন-সাধা ও কল্পনাকে তৃপ্ত করে যাবে। আলোচ্য অংশে কবি প্রকৃতির এই মাহাত্ম্যকে গভীর তৃপ্তি ও মমত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।

আমি চলে যাব বলে... লক্ষ্মীটির তরে: পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেক মানুষকেই এক সময় চলে যেতে হয়। কিন্তু শিশিরের জলে চালতা ফুল ভিজে যে রহস্যময় সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তরে তার কোনো শেষ নেই। আর সেই শিশিরের জলে ভেজা চালতা ফুলের গন্ধের ঢেউ প্রবাহিত হতে থাকবে অনন্তকালব্যাপী। কবির এই বোধের মধ্যে প্রকৃতির এক শাশ্বতরূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে, যেখানে লক্ষ্মীপেঁচাটির মমত্বের অনুভাবনাও ধরা দিয়েছে অসাধারণ এক তাৎপর্যে।

এশিরিয়া ধুলো আজ.... মানুষের গড়া পৃথিবীর অনেক সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। এশিরিয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এখন ধ্বংসস্তুপ ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু প্রকৃতি তার আপন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে চিরকাল প্রাণময় থাকে। প্রকৃতির মধ্যে বিচিত্র গন্ধের আস্বাদ মৃদুমন্দ কোলাহলের আনন্দ, তার অন্তর্গত অফুরন্ত সৌন্দর্য কখনই শেষ হয় না। কবিতাটিতে জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির এই চিরকালীন সৌন্দর্যকে বিস্ময়কর নিপুণতায় উপস্থাপন করেছেন।


মুলবইয়ের অতিরিক্ত শব্দার্থঃ

স্তব্ধ- নিশ্চল, নিঃসাড়, বাকরুদ্ধ, স্তম্ভিত।

নক্ষত্র- তারা, তারকা।

সাধ- আকাঙক্ষা, ইচ্ছা, স্পৃহা, শখ।

স্বপ্ন - সুপ্ত বা নিদ্রিত অবস্থায় কোনো বিষয়ের প্রত্যক্ষবৎ অনুভব, নিদ্রিত অবস্থায় মনের ক্রিয়া বা অনুভূত বিষয়, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কল্পনা, কল্পনা, মিথ্যা বা অলীক আশা।

গন্ধ- ঘ্রাণ, বাস, সুবাস বা দুর্গন্ধ, নাসিকা দ্বারা অনুভূত পদার্থের গুণ।

লক্ষ্মীপেঁচা - দেখতে কুরূপ কিন্তু সুলক্ষণযুক্ত।

গাবে- গাইবে।

শান্ত-  শান্তিযুক্ত, ধীর, অনুদ্বত, শিষ্ট।

মৃদু- নরম, কোমল, আলতো, হালকা, মন্থর, ক্ষীণ, অনুজ্জ্বল, অনুচ্চ, চাপা, শান্ত, ঠান্ডা।

কলরব -বহু কণ্ঠের সম্মিলিত গুঞ্জন, কোলাহল, কলকাকলি।

এশিরিয়া -এশিরীয় সভ্যতা- যা এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়।

বেবিলন- পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যাবিলনীয় সভ্যতা- যা এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নয়।

ছাই- ভস্ম, কাঠ ইত্যাদি দগ্ধ হওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, অসার বস্তু, আবর্জনা।