ষষ্ঠ অধ্যায়
: রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন
মৌলিক আলোচনা
রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্রের উৎপত্তি: রাষ্ট্রের উৎপত্তি
কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল।
শুরুতে আদিম মানুষ গোত্রভিত্তিক জীবনযাপন করত।
বিভিন্ন গোত্রের সমন্বয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তৈরি
হয়।
এই জনগোষ্ঠীকে পরিচালনার জন্য একটি সংগঠিত ব্যবস্থার
প্রয়োজন হয়।
সময়ের পরিবর্তনে একসময় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও
দার্শনিকগণ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা নিচে
উল্লেখ করা হলো:
অ্যারিস্টটল: "স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের জন্য কতিপয় পরিবার ও গ্রামের
সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনই রাষ্ট্র।"
আর. এম. ম্যাকাইভার: "রাষ্ট্র হচ্ছে সরকার
কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন, যার কর্তৃত্বমূলক ক্ষমতা রয়েছে এবং
যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসরত অধিবাসীদের ওপর বলবৎ হয়।"
অধ্যাপক গার্নার: "রাষ্ট্র হলো বহুসংখ্যক ব্যক্তি নিয়ে গঠিত এমন এক জনসমাজ, যারা নির্দিষ্ট
ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, যা বহির্শক্তির নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত এবং যাদের একটি
সুসংগঠিত সরকার আছে, যে সরকারের প্রতি ঐ জনসমাজ স্বভাবতই অনুগত।"
অধ্যাপক গার্নার রাষ্ট্রের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও
পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছেন।
সুতরাং, আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্র হলো একটি ভূখণ্ডভিত্তিক
সমাজ বিশেষ, যার সংগঠিত সরকার ও জনসমষ্টি রয়েছে এবং যার নিজস্ব ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে
অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত আছে।
রাষ্ট্রের উপাদান: রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান
চারটি। এই চারটি উপাদান হলো: ১. জনসমষ্টি ২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ৩. সরকার ৪. সার্বভৌমত্ব।
প্রত্যেকটি রাষ্ট্র এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। কোনো একটি উপাদান অনুপস্থিত থাকলে
তাকে রাষ্ট্র বলা যায় না .
১. জনসমষ্টি:
জনসমষ্টি বলতে বোঝায় রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত একটি
জনগোষ্ঠী।
রাষ্ট্রের প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো
জনসমষ্টি।
জনসমষ্টির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা এবং পারস্পরিক
সম্পর্ক থেকে রাষ্ট্র ধারণার উদ্ভব।
রাষ্ট্রের জনসংখ্যা কত হবে তার কোনো নির্দিষ্ট
নিয়ম নেই। এটি কয়েক হাজার থেকে শুরু করে কয়েক কোটি পর্যন্ত হতে পারে।
উদাহরণ: গণচীন ও ভারতের জনসংখ্যা একশ কোটির উপরে।
অন্যদিকে, স্যান ম্যারিনো ও মোনাকোর জনসংখ্যা যথাক্রমে ৩৩,৭৩৩ ও ৩৮,৯৫৬ (২০২৩ সালের
হিসাব অনুযায়ী)।
২. নির্দিষ্ট ভূখণ্ড:
রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অপরিহার্য উপাদান হলো একটি
নির্দিষ্ট ভূখণ্ড।
ভূখণ্ড বলতে একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা
দ্বারা পরিবেষ্টিত এলাকাকে বোঝায়, যার মধ্যে স্থলভাগ, সমুদ্রসীমা (যদি থাকে) এবং আকাশসীমা
অন্তর্ভুক্ত।
রাষ্ট্রের জনগণের বসবাসের জন্য এবং রাষ্ট্রের
সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ অথবা সাংবিধানিক
উপায়ে একটি জনসমষ্টি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
প্রতিটি রাষ্ট্রই ভূখন্ডের সীমানাকেন্দ্রিক নিরাপত্তা
বেষ্টনি গড়ে তোলে।
ভূখণ্ডের আয়তন ছোট বা বড় হতে পারে। যেমন: রাশিয়ার
আয়তন অনেক বড়, আর দারুস সালাম, সুইজারল্যান্ড, ব্রুনাইয়ের আয়তন ছোট।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি
স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
অনেক সময় একাধিক দ্বীপ মিলেও একটি রাষ্ট্রের
ভূখণ্ড গঠিত হতে পারে। যেমন: জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া।
৩. সরকার:
রাষ্ট্রের তৃতীয় অপরিহার্য উপাদান হল সরকার
সরকার গঠনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ওপর
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তিনটি বিভাগ থাকে: আইন
বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি বিভাগের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হয়, যার মাধ্যমে
রাষ্ট্র গঠন আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে
জনগণ সরকার গঠন করে।
রাষ্ট্রভেদে সরকার পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে।
ব্যাপক অর্থে, সরকার বলতে শাসকগোষ্ঠীর সকলকে
বোঝায়, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে।
অধ্যাপক গার্নারের মতে, "রাষ্ট্র যদি হয়
জীবদেহ, তবে সরকার হলো এর মস্তিষ্কস্বরূপ।"
৪. সার্বভৌমত্ব:
রাষ্ট্র গঠনের মুখ্য উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব
বা সার্বভৌমিকতা।
সার্বভৌম শব্দ রাষ্ট্রের চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে
বোঝায়।
সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের গঠন
পূর্ণতা পায়।
এই ক্ষমতা রাষ্ট্রকে অন্য যেকোনো সংস্থা থেকে
পৃথক করে।
সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের এমন এক বৈশিষ্ট্য
যার ফলে রাষ্ট্র নিজ ইচ্ছা ছাড়া অন্য কারো ইচ্ছার দ্বারা আইনগতভাবে আবদ্ধ নয়।
প্রত্যেক সমাজ ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ
করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকে, আর এই ক্ষমতাই হলো সার্বভৌম ক্ষমতা।
সার্বভৌমত্বের আদেশই হলো আইন এবং সকলে তা মানতে
বাধ্য।
সার্বভৌম ক্ষমতার দুটি দিক রয়েছে: অভ্যন্তরীণ
ও বাহ্যিক।
অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের
মধ্যকার সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে।
জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার থাকা সত্ত্বেও
যদি কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা না থাকে, তবে তাকে রাষ্ট্র
বলা যাবে না।
রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব যতদিন থাকবে, সার্বভৌমত্বের
স্থায়িত্বও ততদিন থাকবে। সরকারের পরিবর্তনে সার্বভৌমত্বের কোনো পরিবর্তন হয় না।
রাষ্ট্রের কার্যাবলি
রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র কী
ধরনের সেবা প্রদান করে এবং এর সামর্থ্য কতটুকু, তা জানা আমাদের জন্য প্রয়োজন। মানব
জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের কাজ। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র প্রধানত দুই
ধরনের ভূমিকা
পালন করে। যথা-
নিয়ন্ত্রণমূলক
কল্যাণমূলক।
এ দুই ধরনের ভূমিকার ভিত্তিতে আধুনিক রাষ্ট্রের
কার্যাবলিকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি
২. কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি
১. অপরিহার্য বা মুখ্য কার্যাবলি
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব
এবং রাষ্ট্রে বসবাসরত জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ
করে, সেগুলোকে অপরিহার্য বা মুখ্য কাজ বলা হয়।
রাষ্ট্রের অপরিহার্য কাজগুলো নিম্নরূপ:
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
আর. এম. ম্যাকাইভার তাঁর The Modern State গ্রন্থে
বলেছেন, 'আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ বা দায়িত্ব। নাগরিকদের জীবন
ও সম্পত্তির নিরাপত্তা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা থেকে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের
সৃষ্টি হয়। জনসাধারণকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করা, সমাজের শান্তি ভঙ্গকারীদের শাস্তির
বিধান করা এবং সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ।'
এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র,
স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ ও অন্যান্য আধা-সামরিক
বাহিনী গড়ে তোলে।
বাংলাদেশে পুলিশ, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা দল
ইত্যাদি,
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।
জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও
সার্বভৌমত্ব রক্ষা
দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং বৈদেশিক আক্রমণ থেকে
দেশ রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন ও পরিচালনা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব।
স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামর্থ্য ও আধুনিকায়ন একটি
রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার
বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব প্রদানে তাদের দেশরক্ষা বাহিনীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
পররাষ্ট্র বিষয়ক অপরিহার্য কাজ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রকে পরিচিত করা।
অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন
করা।
বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন করা।
আঞ্চলিক কোর্ট গঠন করা
বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক বাজার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ
করা।
বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা
ও সেবা প্রদান করা।
রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত সম্পদের ওপর দাবি
প্রতিষ্ঠিত করা।
আইন প্রণয়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
করা.
আইন প্রণয়ন, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকরা
রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ।
রাষ্ট্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্টের মাধ্যমে আইন
প্রণীত হয়।
দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট,
হাইকোর্ট, জজকোর্ট প্রভৃতি বিচারালয়ের মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা
রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজ।
প্রশাসন পরিচালনা
রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন, নিয়ন্ত্রণ
ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
প্রশাসনিক কাঠামোয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ,
কর্মবণ্টন ও নির্দেশ, কাজ তদারক এবং পরিচালনা করা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব।
অর্থনীতি বিষয়ক অপরিহার্য কাজ
অর্থ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্র
পরিচালনায় অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের একটি মুখ্য কাজ।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের
জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করা রাষ্ট্রের আবশ্যিক কাজ।
রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান,
মালিকানার ওপর খাজনা ও কর নির্ধারণ এবং তা আদায় করা ও সুষ্ঠুভাবে ব্যয় করা।
রাষ্ট্র বাজেট প্রণয়ন, মুদ্রা প্রবর্তন ও মুদ্রা
বিনিয়োগের ব্যবস্থা,
গণনা ও পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং মূল্য নির্ধারণ
করে থাকে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা, মুদ্রাস্ফীতি রোধ,
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রভৃতিও রাষ্ট্রের মুখ্য কার্যাবলি।
২. কল্যাণমূলক বা ঐচ্ছিক কার্যাবলি
রাষ্ট্র অপরিহার্য কার্যাবলির পাশাপাশি নাগরিকদের
জীবনমান উন্নত করতে এবং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনে ভূমিকা রাখে। জনকল্যাণ ও উন্নয়নে
রাষ্ট্রের এ কাজগুলো ঐচ্ছিক বা গৌণ কাজ হিসেবে বিবেচিত।
বর্তমানে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কল্যাণমূলক রাষ্ট্র
হিসেবে নিজেদের দাবি করে।
যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে যতবেশি উন্নত তার ঐচ্ছিক
কার্যাবলি ততবেশি বিস্তৃত।
ঐচ্ছিক কার্যাবলি মূলত-
রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও চাহিদার উপর নির্ভর করে।
অপরিহার্য কাজের (আইন-শৃঙ্খলা) মতো বাধ্যতামূলক
নয়।
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কার্যাবলী
বেশি বিস্তৃত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কার্যাবলীসমূহ নিছে তুলে
ধরা হল-
শিক্ষার বিস্তার
রাষ্ট্রের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা রাষ্ট্রের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ। একজন শিক্ষিত
নাগরিক তার অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
হন। একারণে, রাষ্ট্র শিক্ষা বিস্তারের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়।
যেমন-
শিক্ষা সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। কারণ,
শিক্ষিত নাগরিক তার অধিকার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
হন। কাজ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ।
সরকার বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন
করে।
নারী শিক্ষার ওপর গুরুত্বসহ বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা
করে
নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম
পরিচালনা করে।
জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা
জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং বিদ্যমান বিভিন্ন
বৈষম্য ও কুপ্রথা দূরীকরণে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নাগরিকদের স্বাস্থ্য
রক্ষায় রাষ্ট্র যেসব পদক্ষেপ নেয় তা হলো-
নাগরিকদের স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং অসুস্থদের স্বাস্থ্যসেবা
প্রদানে হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসালয়, শিশুসদন, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা
কেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, দেশব্যাপী অস্থায়ী হেল্থ ক্যাম্পেইন প্রতিষ্ঠা
প্রভৃতিও পরিচালনা করে।
জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশুদ্ধ পানীয়জলের সুব্যবস্থা,
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, রোগ প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক টিকা প্রদান প্রভৃতি সেবাও রাষ্ট্র
প্রদান করে।
যৌতুক ও বর্ণ বা গোত্রপ্রথা দূরীকরণ, বাল্যবিবাহ
রোধ এবং জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
খাদ্য নিরাপত্তা
জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য, যেমন- চাল,
ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, তেল ইত্যাদি সরবরাহ প্রক্রিয়া সচল রাখা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ
কাজ।
খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার
আধুনিকীকরণ, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, সার, বীজ, কীটনাশক সরবরাহ, সেচের ব্যবস্থা করা,
খাদ্য গুদামজাতকরণ প্রভৃতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে স্বীকৃত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্যের চাহিদা বেড়ে
যাওয়ায় রাষ্ট্রকে খাদ্য নিরাপত্তায় পূর্বের তুলনায় অধিক মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়ন
একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি তার শিল্প ও
বাণিজ্যের উন্নয়ন ও প্রসারের সঙ্গে জড়িত। শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়নে রাষ্ট্রের গৃহীত
কার্যাবলি হলো-
নিত্যনতুন শিল্প গড়ে তোলা।
বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের
উৎসাহ ও ঋণ প্রদান।
শিল্পজোন প্রতিষ্ঠা ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসার
করা।
উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি ও রপ্তানির জন্য
গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করা।
আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা
অর্জন।
বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার প্রতি মনোযোগ।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা স্থাপন ও পরিচালনার
দায়িত্ব
গ্রহণ এবং এর মাধ্যমে অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান
সৃষ্টি।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ
ঐচ্ছিক কাজ। এর মধ্যে রয়েছে:
রাস্তাঘাট, সেতু, সড়ক, রেলপথ, নৌ-চলাচল, বিমান
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
যোগাযোগের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত থাকা।
সুষ্ঠু পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা রাষ্ট্রের
উন্নতির জন্য অপরিহার্য।
বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট, নেটওয়ার্কিং ও তরঙ্গের
ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের
ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ।
ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষা
জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য
রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক কাজ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের
করণীয়:
জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে দেশীয় শিল্প, গান-বাজনা,
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য রক্ষা করা
লোকশিল্পের সংরক্ষণ, জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়।
জনগণের চিত্তবিনোদনের জন্য প্রয়োজনীয় মঞ্চ, খেলার
মাঠ, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা।
জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষা করা
রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঐচ্ছিক রাজনৈতিক
কাজ হলো জনগণের স্বাধীনতা এবং অধিকার রক্ষা করা। এক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের করণীয়:
জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা,
রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ
নির্বাচনের আয়োজন করা।
জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পরিবেশ
সৃষ্টি, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা প্রদান।
জনগণের বিপরীতমুখী স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর
অধিকার সংরক্ষণ।
সমাজে দুর্নীতি প্রতিরোধ।
শরণার্থীদের আশ্রয় দান করা।
সামাজিক নিরাপত্তা
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক
রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যেমন:
দরিদ্র, বিধবা, অনাথ ও প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা
সম্পন্ন মানুষদের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান।
বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, পেনশন প্রদান।
শ্রমিকদের কল্যাণ
রাষ্ট্রের বিশাল কর্মীবাহিনীকে পরিচালনা করা
ও নিয়ন্ত্রণে রাখা রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজ। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য রাষ্ট্র যেসব
পদক্ষেপ নেয়:
শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য শ্রমনীতিমালা প্রণয়ন।
ন্যূনতম সঠিক মজুরি ও কাজের সময় নির্ধারণ।
কাজের পরিবেশ সৃষ্টি।
বোনাস, ইন্স্যুরেন্স, পেনশন সুবিধা প্রদান।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি।
কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য
শ্রম অফিসার নিয়োগ।
অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ
এছাড়াও রাষ্ট্র আরও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে
থাকে। যেমন:
কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
বনায়ন কর্মসূচি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও
পুনর্বাসন।
দুর্ভিক্ষ ও মহামারি প্রতিরোধ।
নাগরিক সুবিধা সৃষ্টি।
বিদ্যুতায়ন ও জ্বালানি সরবরাহ।
প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।
নগরায়ণ, গ্রামীণ উন্নয়ন।
কালোবাজারি রোধ, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ।
নারী ও শিশু পাচার রোধ।
অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি।
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ রাষ্ট্রকে মোকাবিলা
করতে হয়। তবে সার্বিকভাবে জনগণের কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী
বিশ্বের কল্যাণকামী রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ঐচ্ছিক কাজের পরিধি দিনদিন ব্যাপক
ও বিস্তৃত হচ্ছে।
নাগরিকের ধারণা
রাষ্ট্র গঠনের অপরিহার্য উপাদান হলো জনসমষ্টি।
এই জনসমষ্টিই রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানের ওপর রাষ্ট্রের কার্যক্রমের সফলতা ও ব্যর্থতা
নির্ভর করে।
নাগরিক শব্দের উৎপত্তি
ইংরেজি Citizen শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Civics থেকে
এসেছে, যার অর্থ নগরে বসবাসকারী ব্যক্তি।
ল্যাটিন শব্দ Civics থেকেই Citizen বা নাগরিক
শব্দটির উৎপত্তি হয়।
প্রাচীনকালে নাগরিকের ধারণা
অতীতে যারা শাসনকার্যে সরাসরি জড়িত থাকতেন, কেবল
তাদেরকেই নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটলের মতে,
"সে ব্যক্তিই নাগরিক যে নগর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব ও শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ
করে।" তিনি তাঁর ধারণায় অধিকাংশ জনগণকে নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ,
তাঁর মতে অধিকাংশেরই যথাযথভাবে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করার সামর্থ্য কিংবা অফুরন্ত সময়
নেই।
প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রে দাস এবং নারীদের নাগরিক
হিসেবে গণ্য করা হতো না এবং তারা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারত না।
আধুনিককালে নাগরিকের ধারণা:
বর্তমানে নগর রাষ্ট্রের স্থলে জাতীয় রাষ্ট্রের
উৎপত্তি ঘটেছে। যার ফলে আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ আয়তনে অনেক বড়ো, বিপুল
জনসংখ্যা হওয়ায় সকলের প্রত্যক্ষ শাসনকার্যে অংশগ্রহণ
সম্ভব নয়।
নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের শাসনকার্যে
প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের স্থলে (১) রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং (২) রাষ্ট্রের
রাজনৈতিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ- এই মাপকাঠি ধরা হয়েছে।
হ্যারুন্ড জে লাস্কির মতে, 'যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের
সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে তাকেই নাগরিক বলা
হয়।'
অধ্যাপক গেটেলের মতে, 'নাগরিক হচ্ছে রাজনৈতিক
সমাজের সেসব সদস্য, যারা উক্ত সমাজের প্রতি কর্তব্য পালনে বাধ্য থাকেন এবং সমাজ থেকে
সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকারী হন।'
নাগরিকত্বের সংজ্ঞা:
নাগরিকত্ব বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকার,
নাগরিক সুবিধা ভোগ করা এবং রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে বাধ্য হওয়া।
বৃহৎ অর্থে, নাগরিক হচ্ছেন তিনি, যিনি-
রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
রাষ্ট্রের আইন, সংবিধান ও অন্যান্য নির্দেশের
প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনে নিজের কর্মের মাধ্যমে
ভূমিকা রাখেন।
এবং রাষ্ট্র কর্তৃক বণ্টনকৃত সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক
এবং রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন।
বর্তমানে নারী-পুরুষ, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে
সকলেই নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের শর্তাবলী
বিভিন্ন রকম।
নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব
ও কর্তব্য
রাষ্ট্র যেমন নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার
দিয়ে থাকে, তেমনি নাগরিকদেরও রাষ্ট্রের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়।
অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ
নিম্নরূপ:
১. রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ
রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে চলা।
প্রয়োজনে চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখন্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব
অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সর্বদা সজাগ থাকা
২. আইন ও সংবিধান মান্য করা:
আইন ও সংবিধান মেনে চলা
আইনের প্রতি সম্মান দেখানো
কেউ আইন অমান্য করলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়
এবং স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। তাই সুষ্ঠু জীবনযাপন, শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রত্যেক
নাগরিককে আইন মেনে চলতে হবে।
৩. সততার সাথে ভোট দেওয়া
সততা ও সুবিবেচনার সাথে ভোট দেওয়া নাগরিকের পবিত্র
দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর ফলে যোগ্য ও উপযুক্ত প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত
হবেন।
অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ প্রার্থীকে ভোটদানে বিরত
থাকা উচিত।
৪. কর ও খাজনা প্রদান
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক প্রতিরক্ষা এবং উন্নয়নমূলক
কাজ সম্পাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস নাগরিকদের
প্রদেয় কর ও খাজনা। নাগরিকদের
যথাসময়ে কর প্রদান করে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা
করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা
রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজ
সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা নাগরিকের কর্তব্য।
সরকারের গৃহীত যে কোনো কাজ জনগণের কাজ।
নাগরিকদের সততা, কাজে একাগ্রতা ও নিষ্ঠার ওপর
সরকারের সফলতা, উন্নতি ও অগ্রগতি নির্ভর করে।
৬. সন্তানদের সুশিক্ষিত করা:
প্রতিটি শিশুই রাষ্ট্রের নাগরিক। পিতামাতা তার
অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। সন্তানের প্রতি পিতামাতার দায়িত্ব হলো-
সন্তানদের জীবন রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষেধক
টিকাদান ও সুস্থ সবল রাখা।
নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে পাঠানো।
সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুনাগরিক হয়ে
গড়ে তোলা যাতে তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে।
৭. দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া:
প্রত্যেক নাগরিককেই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
সবসময় দেশের মঙ্গল কামনা করা
নিজস্ব সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় অর্জন ও সফলতার প্রতি
শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
জাতীয় সংগীত, জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় বীর ও মনীষীদের
অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা।
৮. নাগরিক হিসেবে একে অপরকে সহ্য করা
প্রত্যেক নাগরিকের একে অপরকে সহ্য করার ক্ষমতা
থাকতে হবে।
ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
ভিন্নমত মূল্যায়ন করা ও সম্মান করার মধ্য দিয়ে
জাতীয় সংহতি অর্জন
এটা প্রত্যেককেই বিশ্বাস করতে হবে যে, বৈচিত্র্যের
মধ্যেই সৌন্দর্য নিহিত।
৯. দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
সকল প্রকার দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
করা।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বেআইনি কাজের
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্ব।
তবে, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া।
তাহলেই সুশাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা
হবে।
আইনের ধারণা
আইন কী?
সাধারণভাবে আইন বলতে সামাজিকভাবে স্বীকৃত লিখিত
ও অলিখিত বিধিবিধান ও রীতিনীতিকে বোঝায়, যা অধিকাংশ মানুষই সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা
বজায় রাখার জন্য মেনে চলে। সুতরাং আইন হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি বা
বিধিবিধান।
রাষ্ট্র, নাগরিকতা ও আইন
আইনের প্রকারভেদ
আইন মূলত দুই ধরনের-
সামাজিক আইন: সামাজিক জীবনে যে সকল বিধিবিধান
বা রীতিনীতি মানুষ মেনে চলে তা হচ্ছে সামাজিক আইন।
রাষ্ট্রীয় আইন: রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন জাতীয়
নীতিমালার
পরিপ্রেক্ষিতে এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে
কিংবা সমাজে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধে সর্বজনীনভাবে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন
আদেশ-নির্দেশই রাষ্ট্রীয় আইন নামে পরিগণিত।
বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ ও আইনবিশারদগণের সংজ্ঞা:
টি. এইচ. গ্রীন বলেছেন, 'রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত
অধিকার এবং বাধ্যবাধকতাসমূহ আইন।'
অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে, 'আইন হচ্ছে মানুষের
বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের কতগুলো সাধারণ নিয়ম যা সার্বভৌম রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক প্রণীত
হয়।'
উড্রো উইলসন বলেন, 'আইন হলো সমাজের সেইসকল প্রতিষ্ঠিত
প্রথা ও রীতিনীতি যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং যা সরকারের অধিকার ও ক্ষমতার
দ্বারা বলবৎ করা হয়।'
উড্রো উইলসন আইনের একটি উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা প্রদান
করেছেন
আইনের সংজ্ঞা
সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং মানুষের
সামাজিক কল্যাণের জন্য গৃহীত সুনির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টিকেই আইন বলে।
আইনের বৈশিষ্ট্য
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আইনের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ
করা যায় তা নিম্নরূপ:
১. আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও ক্রিয়াকলাপকে
নিয়ন্ত্রণ করে।
২. আইন হচ্ছে সর্বজনীন, তা রাষ্ট্রের সকলের উপর
সমানভাবে প্রযোজ্য।
৩. আইন হচ্ছে একধরনের আদেশ বা নিষেধ, যা সকলকেই
মান্য করতে হয়। যারা আইন অমান্য করে তাদের সাজা পেতে হয়।
৪. আইন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বমূলক কর্তৃপক্ষ হতে
স্বীকৃত এবং আরোপিত।
৫. আইন হলো সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতি
আইনের উৎস
আইন হলো সমাজের চালিকাশক্তি। সমাজের শৃঙ্খলা
বজায় রাখতে এবং মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে আইনের ভূমিকা অপরিসীম। আইনের বিভিন্ন উৎস
রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হল্যান্ড আইনের ছয়টি প্রধান উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন।
হল্যান্ড বর্ণিত আইনের উৎসসমূহ:
১. প্রথা (Custom):
প্রথা হলো আইনের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস।
সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রীতিনীতি, আচার-আচরণ
ও অভ্যাসই হলো সামাজিক প্রথা। এসব সামাজিক প্রথার গুরুত্ব এত বেশি যে, এগুলো অমান্য
করলে সমাজে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
সময়ের সাথে সাথে এসব প্রচলিত প্রথা রাষ্ট্রের
স্বীকৃতি পেয়ে আইনে পরিণত হয়।
উদাহরণ: ব্রিটেনের অধিকাংশ আইনই প্রথা থেকে উদ্ভূত।
২. ধর্ম (Religion):
ধর্মের প্রভাব মানুষের জীবনে অপরিসীম।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন ও ঐশ্বরিক
আইন মেনে আসছে।
ধর্ম, ধর্মীয় অনুশাসন এবং ধর্মগ্রন্থ আইনের গুরুত্বপূর্ণ
উৎস
ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি মূল্যবোধ ধর্মীয়
দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হতো।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয়
রীতিনীতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধানগুলোই রাষ্ট্রীয়
আইন হিসেবে বিবেচিত হয়।
উদাহরণ:
ইসলামী রাষ্ট্রের আইন মূলত কুরআন ও শরীয়াহ ভিত্তিক।
হিন্দু আইন মূলত বেদ, গীতা, রামায়ণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের
উপর নির্ভরশীল।
বর্তমানেও বিবাহ, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে
বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিধি-বিধান ও রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলা হয়।
৩. বিচার সংক্রান্তরায় (Judicial Decisions):
বিচারকের রায় বা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তও আইনের
একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
বিচারকালে বিচারক যদি প্রচলিত আইনের মাধ্যমে
মামলার নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হন তখন তিনি স্বীয় বুদ্ধি, মেধা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে
প্রচলিত আইনের সাথে সঙ্গতি রেখে আইনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারের রায় প্রদান করেন।
বিচারকের এই নতুন ব্যাখ্যা বা রায় একটি দৃষ্টান্ত
স্থাপন করে এবং ভবিষ্যতে তা আইনে পরিণত হতে পারে।
তাই দেখা যায়, বিচারকের রায়ও আইনের একটি উৎস।
৪. বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা (Scientific Commentaries):
আইনবিদদের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, তাদের আইন বিষয়ক
গ্রন্থ আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে।
বিখ্যাত আইনবিদদের ব্যাখ্যা, মূল্যায়ন, আলোচনা
ইত্যাদি থেকে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইনের সন্ধান লাভ করা যায়।
উদাহরণ:
ব্রিটেনের আইন ব্যবস্থায় কোক, ব্ল্যাকস্টোন-এর
অবদান উল্লেখযোগ্য।
আমেরিকার আইন ব্যবস্থায় কেন্ট-এর অবদান রয়েছে।
ইসলামী আইনে ইমাম আবু হানিফা (রা.)-এর মতামত
আইনের মর্যাদা লাভ করেছে।
৫. ন্যায়বোধ (Equity):
যখন বিচারক প্রচলিত আইন বা উপযুক্ত
ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হন, তখন তিনি নিজস্ব সামাজিক নীতিবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার
উপর ভিত্তি করে রায় প্রদান করেন।
এই ন্যায়বোধ থেকে উদ্ভূত আইনও দেশের আইনের মর্যাদা
লাভ করে।
সুতরাং, ন্যায়নীতি ও ন্যায়পরায়ণতা আইনের একটি
গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
৬. আইনসভা (Legislature):
আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভা হলো আইনের প্রধান উৎস।
প্রায় সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা বা আইন
পরিষদ রয়েছে।
আইনসভা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে প্রয়োজনীয় আইন
প্রণয়ন ও সংশোধন করে থাকে।
এছাড়াও, রাষ্ট্রের সংবিধান, রাষ্ট্রপ্রধানের
জারিকৃত প্রশাসনিক আদেশ (ডিক্রি), বৈদেশিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনসমূহ আইনের
উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়
সুশাসনের জন্য আইনের প্রয়োজনীয়তা
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনের অনুশাসন অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। একটি রাষ্ট্রে যদি আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে সকল নাগরিক সমানভাবে
স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এবং রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে। আইনের শাসন
থাকলে কেউ কারও অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
আইনের অনুশাসন মূলত দুটি ধারণা প্রকাশ করে:
১. আইনের প্রাধান্য:
আইনের প্রাধান্য বজায় থাকলে সরকার স্বেচ্ছাচারী
হতে পারে না এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করতে সচরাচর সাহস করে না।
বিনা অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করা, বিনা বিচারে
কাউকে আটক রাখা ও শাস্তি দেওয়া প্রভৃতি আইনের শাসনের পরিপন্থি।
আইনের প্রাধান্য নাগরিক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ।
সমাজে আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে কেউ আইন
অমান্য করে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
সরকারও কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অযৌক্তিক প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না।
২. আইনের দৃষ্টিতে সকলের সাম্য:
আইনের দৃষ্টিতে সাম্য বলতে বুঝায় সমাজে ধনী-দরিদ্র,
সবল-দুর্বল, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই সমান।
আইনের চোখে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে না।
সকলের জন্য একই আইন প্রযোজ্য।
হয়রানির রাষ্ট্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা তখনই খর্ব হয় যখন আইনের অনুশাসন থাকে না। আইনের শাসনের অভাবে নাগরিকরা শিকার হতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে আইনের শাসন কায়েম হয় না।

Social Plugin