বই পড়া
প্রমথ চৌধুরী
মৌলিক আলোচনা
লেখক পরিচিতি
নাম: প্রকৃত নাম: প্রমথ চৌধুরী।
ছদ্মনাম: বীরবল।
জন্ম তারিখ: ৭ আগস্ট, ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দ।
জন্ম পরিচয়:
জন্মস্থান: যশোর। পৈতৃক নিবাস-
হরিপুর, পাবনা।
পিতৃ-পরিচয়:
পিতার নাম: দুর্গাদাস চৌধুরী
পেশা: ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট
শিক্ষাজীবন: মাধ্যমিক এন্ট্রান্স,
কলকাতা হেয়ার স্কুল।
উচ্চ মাধ্যমিক: এফএ, সেন্ট জেভিয়ার্স
কলেজ।
উচ্চতর: বিএ (অনার্স) দর্শন, ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ;
এমএ (ইংরেজি), ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ, প্রেসিডেন্সি কলেজ; বার-এট ল, ইংল্যান্ড।
কর্মজীবন/পেশা: অধ্যাপনাকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
আইন কলেজ। রিসিভার দক্ষিণেশ্বর ও গোপাল পাল এস্টেট। ম্যানেজার ঠাকুর এস্টেট।
সাহিত্যকর্ম:
সম্পাদনা: মাসিক 'সবুজপত্র',
'বিশ্বভারতী' প্রভৃতি।
গল্পগ্রন্থ: চার-ইয়ারি কথা, আহুতি,
নীললোহিত, গল্পসংগ্রহ প্রভৃতি।
প্রবন্ধগ্রন্থ: তেল-নুন-লকড়ি, বীরবলের
হালখাতা, নানা কথা, আমাদের শিক্ষা, রায়তের কথা, প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রভৃতি।
বিশেষ কৃতিত্ব: তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যে
চলিত রীতি এবং কাব্যসাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তন করেন
পুরস্কার: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রদত্ত 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' লাভ।
জীবনাবসান: ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দ (কলকাতায়)।
গল্পের মুলভাব:
বই পড়া, জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও
গুরুত্ব উপলব্ধি করা।
সারসংক্ষেপ:
প্রমথ চৌধুরী 'বই পড়া' প্রবন্ধে বই পড়ার উপযোগিতা
ও পাঠকের মনমানসিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রবন্ধে লেখক বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা
সম্পর্কে তাঁর মতামত ও যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। আমাদের পাঠে অভ্যাসের না থাকার
কারণ হিসেবে লেখক মূলত শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা
আমাদেরকে অর্থ উপার্জন করতে শেখায়, কিন্তু সুশিক্ষিত করে না। যে কারণে সবাই শিক্ষার
ফল হাতে হাতে পেতে আগ্রহী। যে শিক্ষার সাথে আর্থিক যোগ নেই সেই শিক্ষা আমাদের কাছে
অনর্থক বলে বিবেচিত হয়। তাই বই পড়ার প্রতি আমাদের প্রবল অনিচ্ছা, অনাগ্রহ জেগে উঠে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তা অপূর্ণ হওয়ায়ই এই মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি
হয়েছে। সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই স্বশিক্ষিত। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে আমাদের মন বড় হওয়া
দরকার, যা পাঠ-অভ্যাসের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। একজন স্বশিক্ষিত মানুষ কখনও নিচ, হিংসা-বিদ্বেষ
করতে পারে না। স্বশিক্ষিত ব্যক্তি নিজেকে প্রকৃতভাবে চিনতে ও জানতে পারে। এই কারণে
বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সুপরিকল্পিতভাবে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রগতিশীল
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
'বই পড়া' প্রবন্ধটি প্রমথ চৌধুরীর 'প্রবন্ধ সংগ্রহ'
থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
'বই পড়া' প্রবন্ধটি একটি লাইব্রেরির বার্ষিক
সভায় পঠিত হয়েছিল।
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত 'সবুজপত্র' বাংলা সাহিত্যে
চলিত ভাষারীতি প্রবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বই পড়া মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ হলেও প্রাবন্ধিক
কাউকে শখ করে বই পড়ার পরামর্শ দিতে চাননি।
প্রমথ চৌধুরী শিক্ষার মাহাত্ম্য বিশ্বাস করে
সন্দেহাতীতভাবে সাহিত্যচর্চাকে শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ বলে মন্তব্য করেছেন।
প্রাবন্ধিক বলেছেন, 'যে জাতি মনে বড় নয় সে জাতি
জ্ঞানেও বড় নয়। কেননা ধনের সৃষ্টি যেমন জ্ঞান
সাপেক্ষ তেমনি জ্ঞানের সৃষ্টি মন সাপেক্ষ।'
শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোক
মাত্রই স্বশিক্ষিত।
যিনি যথার্থ গুরু তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্বোধিত
করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলেন।
আমরা ভাবি দেশে যত ছেলে পাস করছে তত শিক্ষার
বিস্তার হচ্ছে। কিন্তু পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়।
লাইব্রেরির স্থান স্কুল-কলেজের ওপরে, কারণ সেখানে
গেলে লোকে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়, যা স্কুল-কলেজের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায়
আদৌ সম্ভব নয়।
গুরুত্বপূর্ণ লাইনের ব্যাখ্যা:
লাইন ১: আমরা সাহিত্যের রস উপভোগ করতে প্রস্তুত
নই-
ব্যাখ্যা: আমাদের স্কুল-কলেজের
শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক উলটো-সাহিত্যের রস হলো মানবজাতির মনন ও সৃজনের পরিশীলিত ও কল্যাণময়
আস্বাদন। দুঃখ- ঋণে জর্জরিত আমরা শারীরিক ক্ষুধা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি বলে মনের চাহিদাকে
শৌখিনতা জ্ঞান করে ছুড়ে ফেলছি।
লাইন ২: শিক্ষার ফল লাভের জন্য আমরা সকলে উদ্বাহু-
ব্যাখ্যা: 'শিক্ষার ফল বলতে শিক্ষা
লাভ করে বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোর উপায়কে বুঝিয়েছেন। শিক্ষার ফলে মানুষের আত্মিক ও বস্তুগত
উভয় চাহিদা পূরণের পথ প্রশস্ত হয়। তবে সমাজের বেশিরভাগ লোকই শিক্ষার বস্তুগত চাহিদা
পূরণের দিকটির প্রতি লোভনীয়।
লাইন ৩: এ আশা সম্ভবত দুরাশা-
ব্যাখ্যা: শিক্ষা লাভ করার ফলে
মানুষের বিষয় চাহিদা পূরণ হবে বলে সাধারণ লোকদের বিশ্বাস, আশাবাদ তাকে 'অসম্ভব ও দুরাশা'
বলে অভিহিত করেছেন।
লাইন ৪: তার কোনো নগদ বাজার দর নেই-
ব্যাখ্যা: সাহিত্যচর্চা মানুষের
মানবিকতাকে পরিশুদ্ধ করে তোলে। কিন্তু এই 'জিনিস' ধরা-ছোঁয়ার উর্ধ্বে বলে এটাকে বাজারে
বিক্রি করা যায় না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে জিনিস বাজারে তোলা যায় না সেটার কোনো
মূল্যই নেই।
লাইন ৫: পেশাদারদের মহাভ্রান্তি-
ব্যাখ্যা: বাজারি লোক যদি মনে
করে, যে জিনিস বাজারে তোলা যায় না সেটি মূল্যহীন; তাকে আমরা ভ্রান্তিযুক্ত বলব। ঠিক
তেমনই কিছু পেশাদার মনে করে, পেশায় যা কাজে লাগে না, তা কোনো কাজের নয়। এই ধরনের ধ্যানধারণাকে
তাদের মহাভ্রান্তি বলে উল্লেখ করেছেন।
লাইন ৬: মনগঙ্গার তোলা জল-
ব্যাখ্যা: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের
বিশ্বাস, গঙ্গার জল পরম পবিত্র। এই জলে স্নান করলে শরীর-মন পবিত্র হয়। দর্শন, বিজ্ঞান
ইত্যাদি এমনই শাস্ত্র, যা মনের গঙ্গাজল, যার স্পর্শে আত্মা পবিত্রতা লাভ করে। তবে সেখানে
স্রোত নেই, অর্থাৎ জীবনের অন্তহীন আনন্দ সেখানে নেই।
লাইন ৭: সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত-
ব্যাখ্যা: সমাজের যেসব ব্যক্তি
স্কুল-কলেজের শিক্ষাই শুধু নয়, নিজে অনুসন্ধান ও আগ্রহে জ্ঞানের নানা বিষয়ে চর্চা করেছেন,
তাঁরা নিঃসন্দেহেই সুশিক্ষিতজনে পরিণত হয়েছেন।
লাইন ৮: আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার ঠিক উল্টো
--
ব্যাখ্যা: শিক্ষা বিষয়টি মানুষের
পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে ওঠার এক পদ্ধতি বিশেষ। এর সাথে কৌতূহল, অনুসন্ধান' ও আনন্দের
সম্পর্ক। অথচ শিক্ষা দ্বারা অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমাদের স্কুল-কলেজের
শিক্ষার পদ্ধতি দ্রুত এগিয়ে চলছে একেবারে উলটো-জবরদস্তি ও নিরানন্দের পথে।
লাইন ৯: দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার
হয় না-
ব্যাখ্যা: দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে
মানবজীবন। মানুষ মারা গেলে শ্মশান, গোরস্তান ও চার্চে সৎকারকৃত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা
রেজিস্টার খাতায় লিখে রাখা হয়। কিন্তু মানুষের অন্য সত্তা যে আত্মা, মানবিকতা বোধের
অভাবে আত্মার যে মৃত্যু সেই মৃত্যু নিরূপণ করা বা লিখে রাখা হয় না কোথাও।
লাইন ১০: লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল-
ব্যাখ্যা: শরীর অসুস্থ হলে তা
নিরাময়ে হাসপাতাল আদর্শ স্থান। কিন্তু মানবজীবনের অপর সত্তা আত্মা অসুস্থ হলে তার নিরাময়ে
আপাতদৃষ্টিতে কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রাবন্ধিক এক্ষেত্রে বলেন, মনের বা আত্মার নিরাময়ে
এবং তার উন্নতি সাধনে লাইব্রেরি হচ্ছে আদর্শ স্থান, এক রকম হাসপাতাল।
লাইন ১১: আমাদের শিক্ষাই আমাদের নির্জীব করেছে-
ব্যাখ্যা: শরীর ও মনের সমন্বয়ে
মানুষ। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শরীর টিকিয়ে রাখতে, তার চাহিদা পূরণে নানা পথ
বাতিল করে দেওয়া হয়। কিন্তু মনের চাহিদা পূরণে, তার বিকাশে কিছুই করা হয় না। এতে করে
শরীরের শক্তি হ্রাস পায়, হারিয়ে যায়। ফলে আমরা একসময় নির্জীব হয়ে পড়ি।
লাইন ১২: পাস করা ও শিক্ষিত হওয়া এক নয়-
ব্যাখ্যা: পরীক্ষায় পাস করা হলো
নির্দিষ্ট কিছু পাঠ মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় তা সুন্দরভাবে লিখে দেওয়া। আর শিক্ষিত
হওয়া এক বিশেষ ইতিবাচক রূপান্তর প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে মানুষ জগতের নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান,
মূল্যবোধ ও অনুশাসনে নিজেকে একজন পপরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়।
লাইন ১৩: এক্ষেত্রে দাতাকর্ণের অভাব নেই-
ব্যাখ্যা: দাতাকর্ণ মহাভারতের
বিশিষ্ট চরিত্র, দানের জন্য প্রবাদতুল্য ব্যক্তি। দানে তিনি এতখানি উদার ও মুক্তহস্ত
ছিলেন যে, যুদ্ধকালীন নিজের রুক্ষাকবচও চরম শত্রুপক্ষীয়কে দানে ইতস্তত করেননি। পুঁজিবাদী
সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার বাজারে এক একজন শিক্ষক যেন এক একজন দাতাকর্ণ; যদিও অর্থের বিনিময়ে
তাঁরা বিদ্যাদানের কাজটি করে থাকেন। মূলত লেখক কটাক্ষরূপে উদাহরণটি ব্যবহার করেছেন।
পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত শব্দার্থঃ
শখ- আগ্রহ, পছন্দ।
পরামর্শ- উপদেশ, যুক্তি।
নিরর্থক- অর্থহীন, অনর্থক।
নির্মম - নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, নির্দয়।
দুরাশা- দুর্লভ বিষয়।
অভিজাত - উচ্চবংশীয়, মর্যাদাসম্পন্ন।
সভ্যতা- চালচলনের উৎকর্ষ, আদব।
উত্তরাধিকারী- বংশানুক্রমিক অধিকারী।
আত্মসাৎ- অন্যায়ভাবে নিজের আয়ত্ত বা হস্তগত।
সংক্রামক- ছোঁয়াচে।
লোলুপদৃষ্টি- অতি লোভী দৃষ্টি।
নজির- প্রমাণস্বরূপ, দৃষ্টান্ত, উদাহরণ।
মামলা- মোকদ্দমা, কেস, নালিশ।
লাইব্রেরি - গ্রন্থাগার, পাঠাগার।
সার্থকতা - সফলতা, চরিতার্থতা।
অদ্ভুত- আশ্চর্যজনক, আজব।
কৈফিয়ত- জবাবদিহি।
কৌতূহল- নতুন বা অজানা বিষয় জানার আগ্রহ।
উদ্রেক -উদয়, সঞ্চার, উৎপত্তি।
ঐশ্বর্য- ধন, সম্পত্তি।
প্রচ্ছন্ন- আবৃত, ঢাকা।
জবরদস্তি- জোর, অত্যাচার।
যকৃৎ - কলিজা, লিভার।
অপমৃত্যু - অস্বাভাবিক বা অপঘাতে মৃত্যু।
উৎফুল্ল - অত্যন্ত প্রফুল্ল, উল্লসিত।
কুণ্ঠিত- সংকুচিত, দ্বিধান্বিত, লজ্জিত।
বেয়াড়া - অভ্যাস ও ব্যবহার খারাপ এমন।
প্রত্যাখ্যান- ত্যাগ। গ্রহণ না করা,
ফেরত প্রদান, অবজ্ঞা, অনাদর,
কৃতকর্মা- কৃতী, অভিজ্ঞ।
রীতি- পদ্ধতি, প্রণালি, প্রথা, ধারা।
বাজিকর- জাদুকর।
তামাশা- খেলা, কৌতুক, মজা, পরিহাস, ঠাট্টা।
জখম- ক্ষত, ঘা, চোট, আহত।
অভ্যস্ত- নিত্য আচরণজাত, স্বভাবপ্রাপ্ত।
মনোরঞ্জন- মনের আনন্দদান।
.png)
Social Plugin